নগ্ন আঁচিল ইঁদুর
দৃশ্য-১
মালতী টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়।
নিজের স্তনজোড়া দু'হাত দিয়ে যদ্দুর সম্ভব চেপে ধরে এমনভাবে আড়াল করার চেষ্টা করে এ যেনো স্তন নয়, ফুলে ফেপে ওঠা কোনো আগ্নেয়গিরি।
বেমালুম পড়ে আছে ভাঙচুর করা ঘরের প্রতিটা আসবাব। সিসির টুকরোর উপর গড়াগড়ি খায় খানিকটা তুসকা সিরাপ,
পাশেই পড়ে আছে টেনে টেনে শ্বাস নেবার জন্য বাবার পুরোনো সেই বেকোস্প্রে, রোদে শুকাতে থাকে গত মাসের নারিকেলের খোলে জমা পানি, ভায়োলিন বাজায় কোনো বারো বছরের কিশোরী।
এখানে না, আশেপাশেও না, আসমানের নিচে কোথাও না কোথাও!
বৈষ্ণব পদাবলির সুস্থ অংশ পাশ কাটিয়ে মালতী খুঁজতে থাকে মাকে৷
আগুনে ঝলসে যাওয়া শরীরগুলো পড়ে আছে হেয়ালিভাবে।
চেনার কোনো বৈশিষ্ট্য নেই পোড়া মুখগুলোতে তবুও হাতড়ে খুঁজে নেয়। মুখের উপর ঝুকে সাবধানে কাঁদতে থাকে।
চোখের নোনতা পানি পোড়া চামড়ায় পড়লে যে জ্বালাপোড়া করবে!
মালতীর দ্য লাস্ট গার্ল বইটার কথা মনে পড়ে। আইসিসরা যেভাবে কুর্দিদ ভাষাভাষী সকল ইয়াজিদিদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছিলো, নাদিয়া মুরাদকে যৌন উত্তেজক পোশাক পরিয়ে ডার্টি নন বিলিভার বলে সম্বোধন করতো।
পাশাপাশি তারা নামমাত্র মূল্যে যুদ্ধবন্দী নারীদের কেনাবেচা করতো।
এত অপকর্মের পরেও আইসিসরা যেমন তাদের এমন জঘন্য কাজকে জঘন্য মনে করতো না, গত রাতের পুড়িয়ে হিন্দুনিধনও এদের কাছে জঘন্য বলে মনে হয় নি।
ইতিহাসের কোনো দলিলই যেনো পুরোনো কোনো ঘটনা নয়।
নৈমিত্তিক ঘটে চলে কেবল তাকানোর আলসেমিতে দেখতে পাই না।
ঝাপসা চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে আশপাশটায় চোখ বুলায় মালতী, ক্লান্তি লাগে মানুষপোড়া দেখতে।
গত রাতের সকল কিছু মনে করার চেষ্টা করে।
চারপাশে প্রিয়জন হারানোর আহাজারি,
জীবিতরা কেউ কেউ এখনো আত্মীয়দের খুঁজে পায়নি।
প্রায় হেলে পড়া টিনের ফাঁকা জায়গা দিয়ে কুকুর আসার জন্য মাথা ঢুকিয়ে শরীরে আটকে যায় বারংবার, পুলিশ সাংবাদিকের ভীড়,
অট্ট উচ্ছ্বসিত কিছু জনতা,
আর ঈশ্বর থাকেন চুপ।
আল্লাহু আকবর ধ্বনি তুলে বীভৎসতা!
নিজের ধর্মের ঈশ্বরকে বাঁচাতে তাঁরই সৃষ্টিকে হত্যা।
পুলিশ পটকা মাছের মত পেট দুলিয়ে ডিউটি পালন করে। সাংবাদিকদের উপরমহল থেকে বলে দেওয়া হয়, ভিডিও করতেছেন ভালো কথা কিন্তু মিডিয়ায় প্রচার নিষেধ।
সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে আলোয় ঝলকে ওঠে একের পর এক ক্যামেরা।
মালতীর মনে হয়, এই মানুষের ইতিহাস অন্যায়ের ইতিহাস, এই মানুষদের ইতিহাস মূলত অমানুষদের ইতিহাস।
রাজিয়া পাশে বসে মালতীর কাঁধে হাত রাখে। ওরা একই সাথে না পড়লেও বন্ধুত্ব ছোটবেলার। মা বাদে একমাত্র যার কাছে সস্তির শ্বাস ফেলা যায়।
কারো হাতের স্পর্শে শিউরে ওঠে মালতী। এই বুঝি উল্লাসিত কেউ তেড়ে এসে 'ঘৃণিত নাস্তিক' সম্বোধন করবে কিংবা ক্ষত নিতম্ব চেপে ধরবে!
কিন্তু চেয়ে দেখলো, রাজিয়া পাশে বসে কাঁদছে। মালতী সেই চোখের পানি ভেদ করে দেখতে পেলো লজ্জিত একদলা মুখ।
রাজিয়াই তো অনেক দিন ধরে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে আসছিলো। ইসলামই একমাত্র শান্তির ধর্ম জানান দিচ্ছিলো প্রতিটা উদাহরণে।
সন্ধ্যা মালতী যে প্রতি সন্ধ্যায় রক্তিম আকাশে চেয়ে ঈশ্বরকে খুঁজতো, সেই চিরঞ্জীব ন হন্যতে জগত সংসারে আবিষ্কার করতে কত-শত রাতকে করে দিতো ভোর, হাজার হাজার বইয়ের পাতা শেষ করতো সেই মালতীর কাছে রাজিয়া প্রায়শই সন্ধ্যা বাতি নিয়ে আসতো।
আসা-যাবার পথ বন্ধ করে দিয়েছে এখানের উল্লাসিত দল।
এই লজ্জা মূলত সেই লজ্জা।
দু'জনের কেউ কোনো কথা বলছে না।
কয়েকজন লোক মৃতদেহ গুলো জমায়েত করছে বিশাল এক ট্রাকে।
এক দুই করে গুনছে, তিপ্পান্ন - তিপ্পান্ন -তিপান্ন, চুয়ান্ন-চুয়ান্ন!
এখন হয়ত মালতীর হাতের নাগাল থেকেও সরিয়ে ফেলা হবে তার মাকে।
সেই লোকদের পায়ের শব্দকে এ মুহুর্তে সবথেকে বিশ্রী শব্দ বলে মনে হয়।
মালতী চোখটা বন্ধ করে
এই আশায় যে, কিছু দেখছে না জন্য কিছু হয়ত ঘটবেও না।
ঈশ্বরকে কি ডাকা যায় এখন?
ছোট্ট জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এসে ঈশ্বরকে ডেকে শেষ সময়টা কি অপচয় করবে?
মালতী চোখ বুঝে বিড়বিড় করে, আমাকে তোমার মত ঘুম ঘুম নয়নে দুনিয়া দেখার ক্ষমতা দাও।
যেনো এত এত নিষ্ঠুরতা দেখেও আমি তোমারই মতন উদাসীন থাকতে পারি।
চারপাশে মো মো করছে গোশতপোড়া গন্ধ। মাকে আশেপাশে দেখতে পায় না।
তারা কি ট্রাকে তুলে নিয়েছে?
কা কা শব্দ আসে, বাতাসে হেলতে দুলতে থাকে লাল পেয়ারা গাছ, মাথার ভেতর টায় যেনো ছোট্ট চড়ুই লাফিয়ে চালের বদলে মগজ খুটে খায়, অনবরত ঝাপসা হয়ে আসা চোখে কবুতর ঠোঁট ডুবিয়ে তৃষ্ণা মেটায়।
দৃশ্য-২
এই অঞ্চলের মানুষজন প্রবলভাবে ঈশ্বর ভীরু। যাপিত জীবনের সব কাজে ঈশ্বরকে স্মরণ করে৷ হোক সে কাজ ভালো বা মন্দ৷
কেউ ঘুষ নিতে বলে, তাড়াতাড়ি করুন, নামাজের ওয়াক্ত চলে গেলো।
আবার অন্য প্রান্তে মুসলিম পেষা মাটির দেবীতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
সবখানেই চলছে তো এই রঙ্গ লীলাই।
এদের কেউই তো নিজে ধর্ম বেছে নেয় না। জন্মের সাথে সাথে পূর্ব নির্ধারিত ধর্মের পোশাক গায়ে জড়িয়ে নেয়। যা অর্জিত নয় তা নিয়ে কিসের এত দাম্ভিকতা?
মালতী এই প্রশ্ন অনেকবার রাজিয়াকে করে চুপ করিয়ে দিয়েছিল।
সে নিজেও মানে রাজিয়ার মত কিছু মানুষদের জন্যই এখনও ইসলাম শান্তির ধর্ম বলতে পারে।
কিন্তু মনে হয় রাজিয়ার থেকে মালতী অনেকটা দূরে চলে এসেছে আজকের পর ৷ যেখানে ক্যাপিটাল হিল রয়েছে!
ভিতরটা কালো পানিতে ভাসতে থাকা যেনো এক টুকরো বরফ। ডুবতে চায় কিন্তু কালো জলের ভাসিয়ে রাখার তাগিদ।
মালতীর কপালের সিকিভাগ ঢেকে আছে চুলে, ছাইবর্ণ মুখ আর হরেক রকম স্ট্রাইপ দেওয়া ছেড়া ফ্রক ঝেড়ে কাকড় ফেলা রাস্তায় হাঁটতে থাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে। কামুক পুরুষদের তাকানো মনে করায় গ্রীক পুরাণেও তো বরাবরই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, নারীদেহ পুরুষদের কামাক্রমণের একমাত্র লক্ষ্যবস্তু।
অলিম্পাসের দেবরাজও তার কামদন্ড প্রয়োগ করত দেবী এবং মানবীদের উপর৷
সকল পুরুষের রূপক কৃষ্ণ আরাধ্য এবং রাধা সকল নারীর রূপক একান্ত ভক্ত।
মালতীর মনে হয়, পুরো দুনিয়া তাড়ির হাড়ি এবং সেই তরলে ভাসতে থাকে পোড়াচামড়া বর্ণের গোলাপ।
বিভৎস এক সৌন্দর্য থেকে গন্ধ ছড়ায়।
আশেপাশে জমায়েত কমতে থাকে রাতে, কয়েক পা লাফিয়ে চড়ুই পাখিটাও নীড়ে ফেরে, আর মালতী নীড় ছাড়ে।
কী অদ্ভুত ব্যস্তানুপাতিক মেলবন্ধন!
চারপাশটা মনে হয় আণবিক বোমাগ্রস্ত নগরী। তবুও যেনো বিধ্বস্ত কেউই থেমে নেই।
চায়ের দোকানি চামচ দিয়ে চা'কে টুংটাং শব্দে ঘুলটায়।
একদলা থু ফেলে কেউ তাড়াহুড়ো করে গন্তব্যে দৌড়ায়, সেই থুথু ছোট শিশুর বড় বোনের পুরোনো লম্বা জামায় লাগে, দলের কেউ মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ বলে মুখে ফেনা তোলে, কেউ বা সবার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলে, অমুক তমুক বাদকে বাদ দিয়া আমাগোর পৌঁছাইতে হইবো তৃণমূল পর্যায়ে, তাদের বুঝানো লাগবো তোমাগোর ঘাম - রক্ত, উৎকন্ঠাতেই সবুজ হয় সোনালী।
সবাই যেনো বুকে জমাট ক্ষতের বান নিয়েও একেকজন রেসের প্রতিযোগী।
এখান থেকে পালাবার জায়গা কোথায়?
পেঁজা আকাশ, রাস্তায় প্যাককাদা এবং একটা ব্রোথেলকে পাশ কাটায় মালতী৷
খদ্দেরের জন্য দাঁড়ানো নারীর বুকে মুখ ডুবাতে কেউ কি জিজ্ঞাসা করে তোমার জাতপাত কী?
সেখানে যারা রাত্রি যাপন করে তাদের কী বলে সম্বোধন করা হয়?
কালো পোশাকের চেয়ে দিকে এখন বেশি মানুষের চোখ৷ ভয় হয় না কোনো অশ্লীল জেরার মুখে পড়বার । ভয় হয় বোরকা পরিহিতারা ওর জন্য খদ্দের পেতে কালবিলম্ব হয় কিনা!
দরদাম করা দেখেই হয়ত বাৎসায়ন কামসূত্রে বলেছেন, যুবাবস্থায় কামের সঞ্চয় ও উপভোগ কর্তব্য এবং বৃদ্ধাবস্থায় ধর্ম ও মোক্ষের অনুষ্ঠান করা উচিৎ!
তাই তো করছে তারা।
কিন্তু গড ইজ ডেড, মিশরের ঈশ্বর মরে গিয়েছে, অনেক ধর্মের ঈশ্বর মরে গিয়েছে।
নিজের ধর্মের ঈশ্বরকে টিকিয়ে রাখতে যখন অন্য ধর্মের মানুষদের আঘাত করতে হয় সেই ঈশ্বর মূলত তখনই মরে যায়।
মালতী কি এসমস্ত ভাবছে? অথবা অন্য কিছু?
নাকি ভাবছে সেও যদি মায়ের মত মরে গিয়ে বেঁচে যেতো!
ঝিরিঝিরি করে বৃষ্টি পড়ে। শরীরের ক্ষতে যেনো আগুন ধরে যায়। কাচের টুকরোর মতো চামড়ায় বসে পড়ে তারা!
খাবলে খেতে চায়।
মালতী কাছাকাছি মন্দিরে দাঁড়ায়।
ভেজা কাপড় আটশাট হয়ে থাকে গায়ে। পোড়া চামড়ায় পোড়া জামা বসে যায় দৃঢ়ভাবে। মাঝে মেলবন্ধন তৈরী করে ফসকার গলিত পানি এবং চর্বি।
মালতীর গগনবিদারী ছটফট করতে থাকা আর্তনাদ বজ্রপাতের শব্দে মিলিয়ে যায়।
দশ হাত ছড়িয়ে দেওয়া দূর্গা তবুও মালতীর দিকে চোখ ফিরায় না।
শিল্পী সেই চোখের তারা যেভাবে সৃষ্টি করেছেন সেও সেদিকেই তাকিয়ে থাকেন।
মালতীকে সে দেখতে পায় না, ব্রোথেলকেও দেখতে পায় না, দেখতে পায় না রাস্তার ধারে বৃষ্টিতে ঘুমন্ত কোনো শিশুর মুখ।
ভেজা পোড়া কাপড় শরীর থেকে খুবলে আলাদা করে ফেলে মালতী। যোনী কেশ উন্মুক্ত হয়।
বৃষ্টির রূপ ঝড়ে বদলে যায়।
কল্পনায় মালতী শুনতে পায় ইফতাহ।
এক টানে দূর্গাকে বস্ত্রহীন করে নিজের গায়ে জড়ায় সেই এক টুকরো আদি সৃষ্ট সম্ভ্রম।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন