জন্মদানবিরোধ সব পর্ব একত্রে (শামস অর্ক)



 জন্মদানবিরোধ - ১

.

(সিরিয়ার বিখ্যাত কবি ও মুক্তচিন্তক 'আবু আল আ'লা আল মা'রি'র কবরে স্বরচিত বাক্যে লেখা সমাধিলিপি!)

.

সমাধালিপিটিতে লেখা আছে,

هذا جَنَاهُ أبي عليَّ      وَمَا جَنَيتُ عَلَى أَحَدِ

যার অর্থ হচ্ছে,  'এই অপরাধ (জন্ম দেয়ার) আমার বাবা আমার প্রতি করেছিল, কিন্তু আমি কারো প্রতিই করিনি(কাউকে জন্ম দিইনি)!

.

আরবের কবিতা ও মুক্তচিন্তার ইতিহাস যারা জানেন তাদের কাছে 'আল মা'রি'কে নতুন করে পরিচয় করাতে হবে না। কিন্তু এ লেখায় আলোচ্য কেবল তার 'জন্মদানবিরোধ'! আবু আল মা'রি মনে করতেন জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা এড়াতে সন্তান জন্মদান করা উচিত নয়। তাঁর সমাধিলিপির কথাগুলোতে মনে হতে পারে তিনি বাবার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন, কিন্তু তা মোটেও নয়। তাঁর বাবার মৃত্যুতে শোকাহত কবি রচিত শোক-কবিতা বাবার প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ।  তাই তার সমাধিলিপির মূল বক্তব্য আসলে, 'সন্তানকে যন্ত্রণার জীবন দেয়া অপরাধ, অনৈতিক।' ব্যক্তিগত জীবন ও লেখায় নৈতিকতা ও যুক্তিকে প্রাধান্য দেয়া, নির্লোভ (তাঁর কবিতা বিক্রি করে ধনী হতে নারাজ ছিলেন) চিরকুমার এই কবির ভাষায় তাঁর জীবনের দুটি বন্দিশালা ছিলো, তাঁর অন্ধত্ব (ছোটবেলায় গুটিবসন্তে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন) এবং বিচ্ছিন্নতা (একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতা এক নয়)!

.

ব্যক্তিগত জীবনে নৈতিক কারণে 'নিরামিষভোজী' এই কবির একটি কবিতা না উল্লেখ করলেই নয়:

.

'অনুচিতভাবে পানির মাছ মেরে খেয়ো না,

আর খাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করো না জবাই করা প্রাণীর মাংস,

অথবা (প্রাণী) মায়েদের সাদা দুগ্ধ যা সন্তানের চুমুকের প্রত্যাশায় থাকে, গোয়ালিনীর হাতের টানের নয়,

আর সরলবিশ্বাসী নিরীহ পাখিগুলোর ডিম খেয়ে নিয়ে তাদের শোকাহত করো না,

কেননা কারো প্রতি অবিচারই সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ। 

আর ছেড়ে দাও মৌমাছির কঠোর পরিশ্রম করে সুগন্ধি ফুল থেকে সংগ্রহ করা মধু পান করা,

কেননা অন্যে নিয়ে যাবে বলে এত কষ্ট করে তারা এটা সংগ্রহ করে না,

দান করা কিংবা উপহার দেয়ার জন্যেও সংগ্রহ করে না!

আমি এসব থেকে হাত ধুয়ে নিয়েছি,

তবু মনে হয় যদি আমার চূল ধূসর হওয়ার আগেই আমার এই উপলব্ধি হতো!'

"

জন্মদানবিরোধ - ২

.

'না ছিলাম আমি, খোদা ছিলো!

না হতাম আমি, খোদা থাকতো!

ডুবালো আমাকে এই অস্তিত্ব, 

না হতাম আমি, তবে কিইবা হতো?'


মির্জা আসাদুল্লাহ গালিব তাঁর শেষ বয়সে এমন একটি কবিতা লিখে তার অস্তিত্বের যন্ত্রণা তুলে ধরে বলতে চেয়েছিলেন কিইবা হতো যদি তার জন্ম না হতো? কিন্তু তাঁর জীবনে দেখা যায় তিনি সাতটি সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন! (যদিও তারা সবাই শৈশবেই মারা গিয়েছিল) অস্তিত্বের যন্ত্রণাবোধ কিংবা জন্ম নেওয়া আহামরি কিছু নয় এই উপলব্ধি মির্জা গালিবের যে বয়সে এসেছে ঐ বয়সে ইতোমধ্যে তিনি সাতটি সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন, যদি ঐ সন্তানরা বেঁচে থাকতো, তাহলে তিনি আরো সাতজন মানুষকে তাদের অনুমতি/কনসেন্ট ছাড়াই বিনা অপরাধে অস্তিত্বের যন্ত্রণাবোধের শাস্তি দেয়ার দায় এড়াতে পারতেন না! কিন্তু শেষ বয়সে তাকে যদি সন্তান জন্ম দেয়া বা না দেয়ার বিকল্প গ্রহণ করতে বলা হতো, তিনি হয়তো কখনোই সন্তান জন্ম দেয়ার কথা ভাবতেন না। ঠিক একইভাবে আমাদের সমাজে যারা বাবা-মা হচ্ছে তাদের জীবনবোধ/উপলব্ধি এত কম বা মিথকাঠামো/প্রবৃত্তির দাসত্বে এত সীমাবদ্ধ যে তারা সন্তান জন্ম দেয়ার সময় অস্তিত্বের যন্ত্রণাবোধ উপলব্ধি করে না, তাদের যখন উপলব্ধি হয় (সন্তান জন্ম দেয়া/ নিজেই জন্ম নেয়া ভুল ছিলো) তখন আর কিছুই করার থাকে না!

.

'জীবন সবসময়ই একটি নেতিবাচক ব্যাপার!'  এটা বললে হয়তো অপটিমিজমের মিথ-দাসেরা কিংবা জীবনবাদীরা তেড়ে আসবেন আমার দিকে! কিন্তু তারা কি ভেবে দেখেছেন, কাউকে জন্ম না দেয়া কখনোই অপরাধ/অনৈতিক নয়! 'জীবন অনেক সুন্দর' মিথের আড়ালে প্রবৃত্তির দাসত্ব করা লোকেরা বলবেন, এত সুন্দর জীবন থেকে কাউকে বঞ্চিত করা ঠিক? কিন্তু যার অস্তিত্বই নেই তাকে বঞ্চিত করা যায় কি?

.

এবার আসি জন্ম দেয়াকে অপরাধ বলা যায় কি না প্রসঙ্গে! আপনি নিশ্চয়ই মানেন কাউকে জন্ম না দিলে তার অস্তিত্ব না থাকায় তার কিছু যায় আসে না! তাই আপাতত জন্ম দেয়ার ভ্যালু যে শূন্য তা আপনাকে মানতেই হচ্ছে।  কিন্তু কাউকে জন্ম দেয়ার পর যতটা যন্ত্রণা সে জীবনে ভোগ করবে, আপনার তাকে জন্মদানের কাজটির ভ্যালু ততো বেশি ঋণাত্মক বা নেতিবাচক হবে। আপনি হয়তো বলবেন, সে তো কত সুখও অনুভব করবে জীবনে, সেসবের ইতিবাচকতা কেন বিবেচিত হবে না? কিন্তু আগেই বলেছি তার অস্তিত্ব ছিলো না বিধায় এসব সুখ না পেলেও তার কিছু আসতো যেতো না, এছাড়াও কনসেন্ট/অনুমতি নেয়ার সুযোগ না থাকায় আপনি তার ইচ্ছেয় তাকে এ সুখগুলো দেননি, তাই এগুলো তার উপর আরোপিত সুখ, তার আকাঙ্ক্ষিত নয় বলে এটাকে ইতিবাচক বলার কোনো সুযোগ নেই যখন এর সাথে এক বিন্দুও অনাকাঙ্ক্ষিত যন্ত্রণা সে পাবে, যার জন্য কেবলমাত্র তাকে আপনার নিজের স্বার্থে অস্তিত্বে আনার সিদ্ধান্তটাই দায়ী।

.

আপনি যতভাবেই ব্যাখ্যা করেন কাউকে তার স্বার্থে জন্ম দেয়া যায় না কেননা জন্ম না নিলে তার কোনো ক্ষতি নেই কিন্তু জন্ম নিলে একটু হলেও যন্ত্রণাভোগে ভুগবে এটা সবাই জানে! মা বাবার সন্তানের প্রতি ভালোবাসাকে তার (সন্তানের) অনিচ্ছায় তাকে অস্তিত্বের যন্ত্রণা দেয়ার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া অন্য কিছু মোটেই বলা যায় না! আপনি যদি সত্যিই আপনার অনাগত সন্তানকে ভালোবাসেন, তাকে কাঁটার আঘাত দূরে থাক, ফুলের আঘাতও দিতে না চান তাহলে সবচেয়ে উত্তম/যৌক্তিক উপায় সম্ভবত তাকে জন্ম না দেয়া। কেউ হয়তো বলবেন জন্ম না দিয়ে কিভাবে ভালেবাসা দেখানো যায়? ধরুন, আপনার সন্তানের এখনো পোলিও হয়নি, আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন তাকে পোলিও থেকে রক্ষা করতে আগেই টিকা দিয়ে রাখবেন। এখন কেউ যদি বলে 'সন্তানকে পোলিও টিকা দিয়ে আপনি  আপনার সন্তানের পোলিও হওয়ার পর তাকে সেবা করে তার প্রতি ভালোবাসা দেখানোর সুযোগই রাখলেন না' সেটা হাস্যকর হয়ে যায় না? আপনি যদি চিন্তায় সৎ ও বোধসম্পন্ন হয়ে থাকেন তাহলে হয়তো মানবেন যে, 'দুঃখ এড়াতেই পৃথিবীর মানুষের সব আয়োজন, 'সুখ' এর বিভ্রমে ডুবে থাকার চেষ্টা। '

"


জন্মদানবিরোধ - ৩

.

অনেকেই বলে থাকেন 'আমার সন্তানকে আমি সব বিপদ আপদ থেকে আগলে রাখবো, একটা সুন্দর জীবন উপহার দিবো! এমনটা হলে সন্তান জন্ম দেয়াতে আপত্তি কেন করবেন?'

কিন্তু কথা হলো আপনার সন্তান কি কোনো জড় পদার্থ যে তাকে আগলে রাখতে পারবেন আপনি? ছেড়ে দিতে গেলে সে ভুল করে যন্ত্রণা পাবে আবার আগলে রাখতে গেলে স্বাধীনতাহীনতার যন্ত্রণায় তো ভুগবেই আবার আগলে রাখার ভুল পদ্ধতির জন্যেও বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রণায় ভুগবে! 

আর দুঃখ থেকে আগলে রাখতে পারবেন আপনি?

.

আপনি জন্ম দিয়েই সন্তানকে আসলে মৃত্যু পরোয়ানা হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন যে, সে একদিন অবশ্যই মারা যাবে, সহজ করে বললে আপনি তাকে জন্ম দিচ্ছেন মারা যাওয়ার জন্যই! যদি তার মৃত্যুর ব্যাপার বাদও দিই, আপনি কি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন আপনি সন্তান বড় হওয়ার আগে মারা যাবেন না কিংবা আজীবন সন্তানের ভরসা হয়ে জীবিত থাকবেন? ছোটবেলায় বা যে কোনো বয়সে বাবা-মা হারানোর যন্ত্রণা কি তীব্র সেটা যারা হারায় তারাই বুঝতে পারে! আপনি হয়তো বলবেন আপনি ইচ্ছে করে তো মরে যাবেন না, কিন্তু আপনি মরে গেলে সন্তানের কষ্টের তীব্রতার কথা ভেবে আপনি সন্তান জন্মদান থেকে বিরত থাকতে পারতেন! যে মানুষগুলো সন্তান জন্ম দিয়ে মারা যায় সে মানুষগুলো আসলে এক একজন জঘন্য অপরাধী, নিজের বেঁচে থাকা অনিশ্চিত জেনেও সন্তান জন্ম দেয়ার আগে না ভেবে (এতিম) সন্তানের যন্ত্রণার জীবনের দায় এরা এড়াতে পারে কি? (আবার কিছু মানুষ সন্তানের উপর তার ইচ্ছে চাপিয়ে কিংবা দাম্পত্যকলহ ও বিচ্ছেদের ফলে সন্তানকে দুর্বিষহ জীবন দেয়ার দায় এড়াতে পারে না, তবে সেটা এই পোস্টের আলোচ্য নয়, কেননা এখানে কেবল পিতামাতার সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনিশ্চয়তা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।) 

.

আপনিও মারা গেলেন না ধরে নিলেও আপনি কি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন আপনার সন্তান তার কোন প্রিয় বন্ধু, প্রিয় মানুষকে তার জীবদ্দশায় হারানোর যন্ত্রণায় ভুগবে না কিংবা প্রিয় মানুষ হারানোর ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারবে? আপনি কি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন আপনার সন্তান ভুল প্রেমে পড়ে দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাবে না কিংবা আপনার সন্তানের দাম্পত্য জীবন অসুখী হবে না? আপনি কি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন আপনার সন্তান কোনো দূর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বা বিভৎস অভিজ্ঞতা লাভ করে আজীবন সেটার যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবে না? আপনি কি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন আপনার সন্তান কোনো জটিল রোগ বা যন্ত্রণাদায়ক রোগে কষ্ট পাবে না? আপনি কি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন আপনার চেষ্টার ফলে আপনার সন্তানের সাথে খারাপ কিছুই ঘটবে না যা আপনি চান না তার সাথে ঘটুক?  আপনি কি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন আপনি আপনার সন্তানের জন্য যা ভালো মনে করবেন তাতে সে মন থেকে খুশিই হবে বা তা তার জন্য কল্যাণই বয়ে আনবে? 

.

আমার মনে হয় আপনি এমন কোনো নিশ্চয়তাই দিতে পারবেন না। কেননা মহাবিশ্ব অনিশ্চয়তায় ভরপুর! যে আপনাকে সবকিছু ভালোই হবে নিশ্চয়তা দিচ্ছে আপনি নিশ্চিত থাকুন সে আপনার কাছে কিছু বিক্রি করছে, হোক সেটা অর্থের বিনিময়ে কিংবা আপনার থেকে গুরুত্বলাভের বিনিময়ে!

.

একটা কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, আপনি সন্তান জন্ম দিয়ে তাকে দুঃখ থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করা আসলে সন্তানকে যন্ত্রণার আগুনে ফেলে তার যন্ত্রণা কমানোর বৃথা/অনিশ্চিত চেষ্টা! এর চেয়ে কি সন্তানকে যন্ত্রণার আগুনে না ফেলার কথা ভাবাই উত্তম নয়?

জন্মদানবিরোধ - ৪

.

আপনি কি আপনার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট, সুখী? যদি আপনি আপনার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার কি উচিত আরেকজনকে 'জীবন নিয়ে অসন্তুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে' জন্ম দেয়া? আর আপনি যদি জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ও সুখী হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার সন্তান নেওয়ার কি প্রয়োজন? আর জন্ম দিলেও আপনি কি পারবেন 'আপনার সন্তান তার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট হবে' এমন নিশ্চয়তা দিতে? আপনি কি শারীরিক এবং মানসিকভাবে শতভাগ উপযুক্ত? যদি না হয়ে থাকেন (খুব সম্ভবত কেউই শতভাগ উপযুক্ত নয়) তাহলে কেন সন্তান জন্ম দিয়ে আপনার মধ্যকার ত্রুটি তার অনিচ্ছায় তার উপর চাপিয়ে দিয়ে সেজন্য তাকে ভোগানোর মতো অনৈতিক কাজ করতে চান? ধরে নিলাম, জন্ম দেওয়ার সময় আপনার কোনো প্রকার ত্রুটি ছিলো না, কিন্তু সেটা কখনোই আজীবন কোনো ত্রুটি তৈরি হবে না এমন নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর আপনার মানসিক অশান্তির জন্য সন্তানের সাথে বাজে আচরণের ফলে মানসিক যন্ত্রণা চাপানো কিংবা শারীরিক অসুস্থতার বোঝা চাপানোকে কি আপনি নৈতিক মনে করেন?

.

কোনো কাজ নৈতিক বা অনৈতিক বলার একটি বড় ভিত্তি হলো ঐ কাজের প্রভাবে যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তার অনুমতি। কিন্তু সন্তান জন্ম দেওয়ার ফলে যে সন্তানকে জীবনযন্ত্রণা ভুগতে হবে তার অনুমতি নেওয়া সম্ভব নয়! অবশ্য অনুমতি নেওয়া সম্ভব নয় এমন অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া কাজও নৈতিক বলে বিবেচিত হতে পারে, যেমন: কেউ আনমনে হাঁটতে গিয়ে দূর্ঘটনার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে (তাকে কোনোভাবে সতর্ক করার সুযোগ না থাকলে) তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া। ধাক্কার ফলে সে পড়ে গিয়ে কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত হলেও তার তুলনামূলক লাভ বিবেচনায় সে আঘাতপ্রাপ্তিকে হয়তো নৈতিক বলা যেতে পারে। অনেকে এই ব্যাপারটাকে সন্তান জন্মদানের সাথে মিলিয়ে সন্তান জন্মদানকে নৈতিক প্রমাণের চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু এ চেষ্টার সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো এখানে আপনি জন্ম দেওয়ার আগে আপনার সন্তানের অস্তিত্বই থাকে না, যার অস্তিত্বই নেই তাকে বৃহৎ অকল্যাণের (অনস্তিত্ব মোটেই খারাপ কিছু নয়) হাত থেকে বাঁচাতে জীবনযন্ত্রণা দেয়াটা পরিহাস হয়ে যায়।

.

আরেকটু সহজভাবে বলি, ধরুন আপনার সন্তান পানিতে পড়েনি। আরেকজনের সন্তান পানিতে পড়ে ডুবে মরে গেছে। এখন আপনি কি আপনার সন্তানকে পানিতে ডুবে মরার হাত থেকে বাঁচাতে পানিতে ফেলে উদ্ধার করার চেষ্টা করবেন নাকি আপনি তাকে পানিতেই পড়তে দিবেন না? আপনার যদি কারো সন্তান পানিতে পড়ে মরে যাওয়া দেখে খারাপ লাগে তাহলে আপনার উচিত হবে কারো সন্তান পানিতে পড়ে গেলে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করা, আপনার সন্তানকেও পানিতে ফেলা নয়! তেমনি পৃথিবীতে লক্ষ কোটি শিশু ও মানুষ অনাহারে, নির্যাতনে, চরম মানসিক যন্ত্রণায়, অবহেলায় বেঁচে আছে, আপনি তাদের দেখে মর্মাহত হলে তাদের দুঃখ লাঘবের চেষ্টা করুন, তাদের দুঃখে মর্মাহত হয়ে আপনি নিজে সন্তান জন্ম দিয়ে তাকে যন্ত্রণার জীবন দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা রাস্তার অপরিষ্কার অংশ দেখে মর্মাহত হয়ে পরিষ্কার অংশে নতুন করে ময়লা ফেলে ঝাড়ু দেয়ার মতোই অযৌক্তিক কাজ কেননা আপনার সন্তানকে জন্ম দিয়ে আপনি পৃথিবীর মানুষের কষ্ট লাঘব তো করছেনই না বরং আরো একজন মানুষকে যন্ত্রণার জীবন দিয়ে জীবনযন্ত্রণা ভোগা মানুষের সংখ্যা বাড়াচ্ছেন। যদি পৃথিবীর জন্য কিছু করতেই চান তাহলে অন্তত নতুন করে কাউকে জীবনযন্ত্রণার অস্তিত্ব না দিয়ে একজন অস্তিত্বশীল মানুষের জীবনযন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা করুন।

.

অনেকে এই যুক্তিতে সন্তান জন্মদানের পক্ষে বলেন যে, আমি আমার সন্তানকে এত ভালো রাখবো যে সে তাকে জন্ম দেওয়ার আমাদের সিদ্ধান্তটি নিয়ে খুশিই থাকবে। কিন্তু আগেই বলেছি বাবা-মায়ের হাজার চেষ্টাও সন্তানের জীবন সুখের হবে নিশ্চয়তা দিতে পারে না। আমরা চোখ বন্ধ করে সত্যকে অস্বীকার করে সবকিছু নিজেদের ভাবনার সমর্থনেই ভাবতে চাই! আমরা ভাবি কত ছেলে মেয়ে বাবা-মাকে তাকে জন্ম দেয়ার জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছে, কত ছেলেমেয়ে বাবা-মাকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে, সেবা করে কিন্তু আমরা এই সত্য স্বীকার করতে চাই না যে সকল সন্তান তাদের অনিচ্ছাতেই সমাজ ও পরিবারের শিক্ষা ও তার প্রতি অযাচিত যত্ন ও সেসবের ফিরিস্তি শুনে বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার শেকলে বন্দী হয়ে থাকে। একটি খাঁচায় বন্দি তোতাপাখি যদি বলে, 'সে তাকে এত যত্ন করায়, খাবার দেয়ায় তাকে খাঁচায় বন্দি করা মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞ' তাহলে সেটা কি প্রকৃত সত্য বলে মেনে নিবেন? আপনার সত্যানুরাগ ও চিন্তাশীলতা না থাকলে হয়তো মেনে নিবেন, কিন্তু সত্যানুরাগী চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই মানবেন মানুষ পাখির মতোই স্বাধীন থাকতে চায় তবুও সে  তোতাপাখির মতোই পরিবার ও সমাজের শেখানো কৃতজ্ঞতা, মায়ার বুলি বলে যেতে বাধ্য হয়! কত ছেলে মেয়ে শুধু বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে, তারা কষ্ট পাবে ভেবে চুপ করে তাদের সব অযৌক্তিক কথা মেনে নেয়, তাদের উপর চাপানো যন্ত্রণা সয়ে হাসিমুখের অভিনয় করে যায় (উদাহরণ হতে পারে বাবা-মায়ের চাপিয়ে দেয়া খারাপ পরিবারে বিয়ে হওয়া মেয়েগুলো), মুখ ফুটে প্রতিবাদটুকুও করতে পারে না, সেটা উপলব্ধি না করলে আপনার কখনোই মাথায় ঢুকবে না সমাজে এত অবিচার-অনাচার সত্ত্বেও কেন মানুষ চুপ করে থাকে? তাই একটু গভীরে ভাবুন, স্বৈরাচারী শাসক অপছন্দ অবশ্যই করুন, তার আগে নিজে যেসব স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত চাপাচ্ছেন আপনার সন্তান ও অন্যদের উপর, সেসব উপলব্ধি করুন!

এক পাঠকের মন্তব্য ও আমার জবাব:

.

পাঠক: 

(জন্মদানবিরোধ-৪) লেখনির প্রথম অংশটুকু নিয়ে কিছু বিষয়,


আমি জানি না ভাইয়া,আমার বাবা-মা যদি জন্মদানের বিপক্ষে থাকত,তাহলে আদৌ আমার জন্ম হত কিনা!


এখন নিশ্চয়তা এবং অনিশ্চয়তা তো সব কিছুতে বিদ্যমান।আমরা যারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি,যত ভাল ভাবেই পড়ি,নিশ্চিত কখনোই বলতে পারি না,সিজিপিএ খুব ভাল হবে।এজন্য কি লেখা পড়া বাদ দিয়ে বসে থাকব!


অনস্তিত্ব ভাল কিভাবে ভাইয়া? জগতের অস্তিত্ব না থাকলে আমরা এতকিছু পেতাম!আজকে তথ্যপ্রযুক্তির অস্তিত্ব না থাকলে,আপনি আমি আমাদের চিন্তা এভাবে সাবলীল ভাবে শেয়ার করতে পারতাম!


হ্যাঁ,আপনি হয়ত বলবেন,জগত থেকে লাভ কি হল,আমি তো সুখে নাই।


এখন একটা মানুষ যে সুখে নাই,এর জন্য দায়ী তো পুরো সমাজ,অতীত ইতিহাস সহ সব কিছু!


আবার যারা সুখে আছে,তারা সুখটা উপলব্ধিই করতে পারতেছে দুঃখ আছে বলে।এটাই তো জীবন! কেউ তো কপ্লিট স্যাডনেসে সারা জীবন পার করে না।অনেক আফগান ছেলে/মেয়েরা ইউরোপে পড়াশোনা করে নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।আবার যারা এক্সট্রিম,আই মিন তালেবান,এরাও দেখবেন ওই আবদ্ধ থাকতেই শান্তি বোধ করতেছে।


আবার আপনি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকান,কি নেই তাদের!  আমেরিকায় বেকাররা মাসে প্রায় ৩০০০ হাজার ডলার ভাতা পাচ্ছে(যেখানে চাকরিজীবিরা ১৫০০ ডলার কামায়),তাও ওদের আত্মহত্যার সংখ্যা আমাদের চেয়ে এত বেশি কেন? হু এর আত্মহত্যার ডাটায় ওরা ৩৪ নাম্বারে আর আমরা ১৩০ এ! রাশিয়া আছে ৩ এ।সাউথ কোরিয়াও ১০ এর ভিতরে।এমন আরো কিছু উন্নত দেশ আছে ভাইয়া।  

সুখে থাকলে আত্মহত্যা কেন করবে আমি জানি না।


সুখটা বরাবরই আপেক্ষিক আর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।


আর বাচ্চাদানের বিষয়ে অতিরিক্ত নেয়াটা আমারও অপছন্দ।কারণ একটি বাচ্চার সুস্থ লালন পালনের পরিবেশ এখন পাওয়া খানিকটা দুঃসাধ্য আমাদের এদিকে।


তবুও ভাই জন্মদান আটকে দিলে আটকে যাবে সভ্যতা,আটকে যাবে আমাদের চিন্তার ধারা, আটকে যাবে প্রায় সবকিছু।

.

আমার জবাব:

.

আপনি পড়াশোনা বাদ দিলে বা করলে আপনার ক্ষতি বা লাভ হচ্ছে, কিন্তু জন্মদানে অন্য একজন মানুষ সংশ্লিষ্ট, দুটো ব্যাপারকে এক করা যায় কি? অনস্তিত্ব ভালো বলিনি আমি, বলেছি খারাপ কখনোই নয়! আপনি চিন্তা শেয়ার না করতে পারলে বা জন্ম না নিলে আপনার কিইবা ক্ষতি হতো যেহেতু আপনার অস্তিত্বই ছিলো না। আপনার মৃত্যুর পর আপনি আস্তিক হয়ে থাকেন বা নাস্তিক, পৃথিবীতে আপনার উপভোগ করা সুখের কোনো মূল্যই থাকবে না! আপনি কি ভাবছেন নিজের জন্মস্থান ছেড়ে মানুষ খুব সুখে বাইরে যায়? সুখের লোভে যায়, কতজন পায় সেটা তাদের ভেতরে দেখে জেনেছেন? আর বাহ্যিক সুখ দেখে বিচার করলে তো পৃথিবীর অনেক মানুষকেই সুখী মনে হবে যেটা বাস্তবতা নয়। আর তালেবান জঙ্গীরা অন্যদের হত্যা করে যে শান্তি পাচ্ছে বলে ভাবছেন আপনি, আপনি কি নিজে ঐ শান্তিটা চান? আসলে সবাই তার পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে থাকাকে শান্তি বলে সান্ত্বনা খোঁজে। আপনি জন্মেছেন, আপনি সুখে থাকার চেষ্টা করবেন, সেজন্য বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন এসব তো দোষের নয়, কিন্তু দোষ হলো একজন নতুন মানুষকে অনিশ্চিত এবং যন্ত্রণার জীবন দেয়াটা! এই যে একটা সুন্দর সত্য উপলব্ধি করেছেন, দারিদ্র্যতা আপনাকে নিশ্চিতভাবে কষ্ট দিবে, আপনি হয়তো সে কষ্টকে শান্তি ভেবে সান্ত্বনা খুঁজবেন কিন্তু ধন-সম্পদও আপনার মানসিক শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে না। সুখের জঘন্য সংজ্ঞাটা আপনি সম্ভবত জানেন, অন্যে কষ্টে আছে দেখে সে তুলনায় আমি ভালো আছি ভাবার (জঘন্য) মানসিকতাটাই সুখ! এই সুখটা যার অস্তিত্ব নেই তার উপর চাপানোর জন্য তাকে জন্ম দেওয়ার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। আপনার ভাবনাকে শ্রদ্ধা করি আমি, পৃথিবীতে একটি বাচ্চাকে সুনিশ্চিত পরিবেশ দেওয়াটাও দুঃসাধ্য, তাই জন্মদানের আগে ভাবা উচিত। ভাই পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত প্রাণী ও অন্য মানুষদের প্রতি মানুষ কর্তৃক যে নির্মমতা হচ্ছে (আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না কেউ অত্যাচারী বা অত্যাচারিত হোক), যত মানুষ বাড়ছে তার চেয়ে বেশি মানুষকে হত্যার অস্ত্র মজুদ হচ্ছে, বিশ্বের বড় অংশকে নিদারুণ কষ্টে রেখে কেবল পুঁজিপতিরা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকছে (যদিও অনেকেই মানসিক শান্তি পায় না), ক্রমে বাতাস, পানি দূষণ হচ্ছে, প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে, মানুষ জটিলতর রোগে আক্রান্ত হয়ে যান্ত্রিকভাবে দীর্ঘজীবী হচ্ছে, এসবকে আপনি সভ্যতার ধারা বলতে চান? এসব আটকে যাওয়া নিয়ে ভাবছেন?


জন্মদানবিরোধ - ৫

.

আপনি কি সুখী? যদি আপনি বিবাহিত হয়ে থাকেন, তাহলে প্রশ্ন আসবে আপনি কি বিয়ের আগে সুখী ছিলেন না? যদি আপনার সন্তান থেকে থাকে, তাহলে প্রশ্ন আসবে আপনি কি সন্তান নেয়ার আগে সুখী ছিলেন না? 

.

এমন প্রশ্ন কেন করলাম? আপনি কি জানেন যে 'মানসিক অস্থিরতা' ও 'মানসিক শান্তি' দুটো বিপরীত জিনিস? আপনি একা জন্মেছেন এবং আপনার অনিচ্ছা সত্ত্বেও জন্মসূত্রে বাবা-মা, ভাই-বোন সহ অনেক আত্মীয়-প্রতিবেশী পেয়েছেন! এসব পেয়ে যদি আপনি সন্তুষ্ট হতেন এবং স্থির থাকতে পারতেন, আপনি কখনোই কোনো নতুন সম্পর্কে জড়াতে চাইতেন না। কিন্তু এমনটা মানুষের বৈশিষ্ট্য নয়, মানুষ পরিবার-প্রতিবেশী-আত্মীয় এদের মাঝে থেকেও একা অনুভব করে, তাই সে জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়। জীবনসঙ্গী খোঁজা মানে নিজের একাকীত্ব দূর করার জন্য অপর একটি স্বাধীন সত্ত্বাকে সম্পর্কের শৃঙ্খলে কিছুমাত্রায় হলেও বন্দী করার চেষ্টা।  আমি বলছি না এটা খারাপ, কেননা এক্ষেত্রে যদি আপনার জীবনসঙ্গী প্রাপ্তবয়স্ক ও বোধসম্পন্ন হয় এবং আপনার সাথে সম্পর্কের শৃঙ্খলে থাকা পছন্দ করে, তাহলে আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। আমি যেটা দেখাতে চাচ্ছি, সেটা হচ্ছে মানুষ একা, অসুখী ও অস্থির বোধ করে বলেই ভিন্ন একজন স্বাধীন মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করে হলেও নিজের একাকীত্ব দূর করতে চায় অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে সুখী মানুষ বিয়ে করে মনে হলেও প্রকৃত বাস্তবতা হলো একজন একা (কিংবা ভবিষ্যতে একা হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকা), অস্থির এবং অসুখী মানুষই বিয়ে করে! একা সুখে-শান্তিতে থাকতে পারা কোনো মানুষ অন্য মানুষের সাথে শৃঙ্খলিত হতে চাইবে না বলেই আমার মনে হয়!

.

বিয়ের প্রসঙ্গটা আসলে আমার মূল আলোচ্য নয়! মূল আলোচ্য হচ্ছে বিয়ের পরে সন্তান জন্ম দেয়াটা। আমরা সাধারণত প্রেমের সম্পর্কে বলতে শুনি, 'শুধু তুমি পাশে থাকলে আমার আর পৃথিবীতে কিছুই চাই না।' এ কথাটি যে শুধু মানুষের অন্য সম্পর্ক ও চাহিদার জন্য মিথ্যা - কেবল তা নয়, একটি সন্তান জন্ম দিয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ সেটা মিথ্যা প্রমাণ করে! আর যদি আপনি কাউকে কেবল সন্তান জন্মদানের জন্য বিয়ে করে থাকেন তাহলে আপনি মুখে যা ই বলুন, আপনি আপনার জীবনসঙ্গীকে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবেই ভেবেছেন! এবার আবার একটু পিছিয়ে যাই! আপনি যেভাবে জন্মগ্রহণ করেছেন সেভাবে সুখে-শান্তিতে ও স্থির থাকতে না পারায় আপনি বিয়ে করেছেন! এখন আপনি জীবনসঙ্গীর সাথে পরিপূর্ণ সুখে-শান্তিতে থাকলে আপনি ওভাবেই স্থির থাকতে চাইতেন। কিন্তু না, (সন্তান জন্ম না দেয়ার উপায় থাকতেও) আপনি সন্তান জন্ম দিচ্ছেন! কেন? কারণ আপনি আপনার জীবনসঙ্গীকে সবসময় পাশে পাচ্ছেন না বা তার সাথে আপনার সম্পর্ক নিয়ে আপনি পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট নয় বলেই বিয়ের পরেও একাকীত্বে, অস্থিরতায় ভুগছেন! সে একাকীত্ব কাটাতে নিজের স্বার্থে একাকীত্ব দূর করার খেলনা হিসেবে একটা নতুন মানুষকে যন্ত্রণার অস্তিত্ব দিচ্ছেন! তাই সৎ উপলব্ধিসম্পন্ন মানুষ হলে সন্তান জন্ম দিয়ে সন্তানের মহা উপকার করেছেন না ভেবে প্রকৃত বাস্তবতা উপলব্ধি করে আয়নায় নিজের স্বার্থপর চেহারাটা দেখুন। আর আপনি যদি বলেন, আপনার ইচ্ছে ছিলো না সন্তান জন্ম দেয়ার, সমাজ ও পরিবারের চাপে বা আঁটকুড়ে-বন্ধ্যা এসব অভিযোগ শুনতে চান না বলে সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য হয়েছেন, তাহলে আপনার ভাবা উচিত আপনি একজন মানুষকে এমন সমাজে আনছেন যেখানে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও অনেককিছু করতে হয়!

.

মানুষ একটি উন্নত মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধ প্রাণী! মানুষ কোনো কাজ ফল লাভের আশা ছাড়া করতে পারে না। মুখে যতোই উদার, স্বাধীনচেতা বুলি আবৃত্তি করেন আপনার সন্তানের জন্য আপনি প্রত্যাশা ছাড়া কষ্ট করতে পারবেন না, নিজের অজান্তেই আপনার প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়ে দিবেন তার উপর। এছাড়া আপনি না চাইলেও সন্তান শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতার বোঝা বয়েই অনেক ত্যাগ মুখ বুঝে স্বীকার করে যাবে, যা আপনি মস্তিষ্ক ব্যবহার করলেই বুঝবেন। বুঝে যদি আপনি আপনার সন্তানকে তার মতোই চলতে দেন তখন সে ভুল করে নিজেও কষ্ট পাবে, আপনিও মনঃকষ্টে ভুগবেন। এছাড়া আপনি জন্ম দিয়েছেন ভেবে আপনার মনে সন্তানের উপর অধিকারবোধ জন্মানোয় আপনি তাকে মারবেন বা বকবেন, জীবনসঙ্গী বা কর্মজীবন ও অন্যান্য হতাশা আপনার সন্তানের উপর চাপিয়ে দিবেন।

.

আপনি হয়তো বলতে পারেন সন্তান জন্ম দেয়া এবং তৎসংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী তো একেবারেই প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি, সবার জীবনেই ঘটছে, তাহলে আমি বলবো আপনি স্বীকার করুন আপনি অন্য প্রাণীদের মতোই প্রবৃত্তির দাসত্ব করছেন, নৈতিক কিছুই করছেন না। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে আপনি যে উন্নত মস্তিষ্কের অধিকারী, তাতে প্রবৃত্তির দাসত্ব করা মানুষ হিসেবে আপনার জন্য অপমানজনক। আপনি হয়তো বলবেন আমার বাবা-মা আমাকে জন্ম দেয়ার জন্য আমি পৃথিবী দেখেছি, তাহলে আমি কেন আরেকজনকে পৃথিবী দেখার সুযোগ দিবো না? (পৃথিবী দেখার সুযোগ না পেলে যে অস্তিত্বহীন কারো কিছু যায় আসে না কিন্তু অস্তিত্বে আনলে যন্ত্রণায় ভুগতেই হয় সেসব আগে আলোচনা করা হয়েছে।) 

এ প্রসঙ্গে আমি বলবো বাবা-মা আমাকে জন্ম দেয়া অপরাধ ছিলো না কিন্তু তাদের উপলব্ধির সীমাবদ্ধতা অবশ্যই ছিলো। যে কারণে আমাদের পূর্বপুরুষেরা পারমানবিক বোমা আবিষ্কার করলেও আমরা বর্তমানে চাই না সে বোমা ব্যবহৃত হোক, ঠিক একই কারণে আমাদের বাবা-মা আমাদের জন্ম দিলেও অনাগত সন্তানদের সম্ভাব্য যন্ত্রণা উপলব্ধি করে আমাদের সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা ব্যবহার অনুচিত বলে আমি মনে করি।

জন্মদানবিরোধ - ৬

.

পৃথিবী কি দিনে দিনে আরো বাসযোগ্য হচ্ছে বা হবে? আপনি যদি উটপাখির মতো বালির নিচে মাথা লুকিয়ে বাস্তবতা অস্বীকার না করেন তাহলে নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারবেন- পৃথিবীর জীবের জন্য অত্যাবশকীয় বায়ু, পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে, প্লাস্টিকের বর্ধমান ব্যবহার মাটিকেও করছে দূষিত, মানুষ কর্তৃক নির্বিচার বন ও প্রাণী ধ্বংসে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে, প্রাকৃতিক জ্বালানি সহ অন্যান্য সম্পদ ক্রমেই ফুরিয়ে যাচ্ছে! আর আগ্নেয়াস্ত্র, রাসায়নিক অস্ত্র, জীবাণু অস্ত্র, পারমানবিক অস্ত্র সহ নানা মারণাস্ত্র ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে যেগুলোর ব্যবহার যেকোনো সময় মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

.

আপনি সমুদ্রের তীর থেকে দু-একজনের প্লাস্টিক কুড়ানো দেখে পরিবেশ সুন্দর হয়ে যাচ্ছে ভেবে আনন্দিত হতেই পারেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো যে পরিমাণ প্লাস্টিক কুড়ানো দেখে আপনি আনন্দিত হচ্ছেন তার চেয়ে বহুগুণ প্লাস্টিক বর্জ্য আপনি নিজেই সৃষ্টি করছেন! এমনিতেই আপনি যে অন্ধ জৈবিক নকশায় নির্মিত তা আপনাকে ইতিবাচকতার চশমা পরিয়ে রাখে, তার উপর পুঁজিবাদ-ভোগবাদ-জাতীয়তাবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-রাজতন্ত্র-ধর্ম-সমাজতন্ত্র এসব টিকিয়ে রাখতে সুবিধাভোগীরা আপনাকে কঠিন বাস্তবতা ভুলিয়ে নিজের স্বার্থ নিয়ে ভাবতেই উদ্বুদ্ধ করে। আর আপনি যদি কেবল নিজের স্বার্থের কথাই ভাবেন, তাহলে এই 'জন্মদানবিরোধ' লেখাটি আপনার জন্য নয়!

.

পৃথিবী ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হবে এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আপনার ও এ যুগের মানুষদের অবিবেচক কর্মকাণ্ডের ফলে নিকট ভবিষ্যতের প্রজন্মই ভুগবে। আজও পৃথিবীর একটা বড় অংশের মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে না, খাবার না পেয়ে রাতে ঘুমোচ্ছে, ভোগবাদীদের ভোগের ফলে সৃষ্টি হওয়া পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজদের সৃষ্ট যুদ্ধের নির্মমতার শিকার হচ্ছে,  তাদের কথা যদি আপনি ভাবা বাদ দিয়ে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে এ লেখা আপনার জন্য নয়! 'আমার দেশে তো যুদ্ধ হচ্ছে না', 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে, অন্যের সন্তান মরুক ধুঁকে কি যায় তাতে!' এমন মানসিকতার লোকজনদের জন্যেও এ লেখাটি নয়।

আশাবাদী হওয়া দোষের নয়, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন আছে। তবে নিজের আশার জন্য ভবিষ্যত মানুষদের বিপর্যয়ে ফেলাটা অবশ্যই দোষের!

.

সুকান্ত ভট্টাচার্য ২১ বছরেরও কম বয়সে উপলব্ধি করেছিলেন এ পৃথিবী নবজাতকের বাসযোগ্য নয়, তিনি অঙ্গীকার রাখতে না পারলেও অন্তত নবজাতকের জন্য পৃথিবী বাসযোগ্য করার কথা ভেবেছিলেন। সমরেশ মজুমদারের 'গর্ভধারিণী' উপন্যাসে জয়িতা একটি বাসযোগ্য সমাজ গড়ে তোলার পরই সন্তান জন্ম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো! কিন্তু বাস্তবে বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলা কি এতই সহজ? যদি এতই সহজ হতো, আমাদের পূর্বপুরুষেরা কেন আমাদের অধিকতর বাসযোগ্য পৃথিবী দিতে পারেননি? তারা পারেনি বলে আমরা পারবো না, চেষ্টা করবো না এমনটা বলছি না, কিন্তু সে চেষ্টায় সফল হওয়ার আগেই কেন ক্রমে বসবাস-অযোগ্য হওয়া একটি পৃথিবীতে কাউকে জন্ম দিচ্ছি আমরা? আমাদের সন্তানেরা পৃথিবীকে আরো সুন্দর করবে এমন আশা আমরা তখনই করতে পারতাম যখন আমরা অতীতের চেয়ে পৃথিবীকে অধিক বাসযোগ্য করে তুলতে পারতাম!

.

জন্মদান একেবারে স্বাভাবিক - প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, এটাকে অস্বীকার করা তো প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়া! মানুষ অন্ধ জৈবিক প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের বিকাশের ফলে যন্ত্রণা যেভাবে উপলব্ধি করতে শিখেছে, তা অন্য অনেক প্রাণী উপলব্ধি করতে শেখেনি। একটা বাঘ বা সিংহ যন্ত্রণায় ছটফট করা হরিণকে জীবিত অবস্থায় তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারলেও মানুষ সেটা পারে না, কেননা মানুষ যন্ত্রণাটা উপলব্ধি করে! কিন্তু মানুষের সমস্যা হলো তারা ঐ হরিণকেই যন্ত্রণা দিয়ে তার অগোচরে হত্যা করে তাকে মাংস খেতে বললে সে দ্বিধা করে না! ঠিক তেমনিভাবে মানুষ তার সন্তানের বাহ্যিক যন্ত্রণাটুকু সহ্য করতে পারে না অথচ তাদের অগোচরে যে মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে সন্তান, সেটা তাদের ভাবনাতেই  আসে না! কিন্তু মানুষ হয়ে যখন জন্মেছি, ভাবনার মতো মস্তিষ্ক যখন পেয়েছি, তখন আমাদের ভাবাটা কেবল উচিতই নয়, একপ্রকার কর্তব্যও বটে।

জন্মদানবিরোধ (উক্তি) - ১

.

(জার্মান ডাক্তার ও জন্মদানবিরোধী) কারনিগ বলেন,

.

"আপনি (জন্মদানকারী) মনে করেন আপনি অনেক কঠিন, সুন্দর, মহৎ কিছু বলে ফেলেছেন বা করে ফেলেছেন, তাই নয় কি? কিন্তু আপনি জানেন, এটা আসলে কি? এটা আসলে মানবীয় দুর্বলতা ও অজ্ঞতা! আমি সেই সকল জীবের (সন্তানের) জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি যাদের আপনারা এ পৃথিবীতে এনেছেন এবং তারা আপনাদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জন্মের সময় প্রতিবাদটুকুও করতে পারেনি, অন্যথায় যারা আপনার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানাতো, যেহেতু এ অস্তিত্ব যন্ত্রণা ও ধ্বংসই বয়ে আনে! (যদিও কিছু 'জন্মদানবিরোধী' জন্মের সময় শিশুর কান্নাকে তাকে যন্ত্রণার অস্তিত্ব দেয়ার প্রতিবাদের রূপক হিসেবে মনে করেন!) আমাদের মানবজাতি পৃথিবীর কোনো উপকারেই আসে না, তবুও টিকে থাকে আপনাদের মতো দুজন মানুষের অবিবেচক সিদ্ধান্তে, যারা কোনো বিষয় গভীরে ভেবে, যাচাই করে, উপলব্ধি করে সিদ্ধান্ত নেয় না!

জীবন যন্ত্রণার, তাই নতুন কাউকে জন্মদান থেকে বিরত থাকাই প্রকৃত মানবপ্রেম ও কর্তব্য।"

জন্মদানবিরোধ - ৭ (খসড়া)

.

একটা জীবনের জন্ম দেয়া কি এতই তুচ্ছ ব্যাপার? আপনি জন্ম দেয়ার মাধ্যমে একজন অনুভূতিশীল মানুষকে জীবন চাপিয়ে দিচ্ছেন। এই চাপানো জীবন যে সবসময় তার জন্য সহজ, সুন্দর বা পছন্দের হবে এমন নয়! আপনার অনেক ধন-সম্পদ, রাজত্ব থাকলেও যদি সেসব সন্তানের জন্য মানসিক শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারতো, তাহলে হয়তো সিদ্ধার্থ (গৌতমবুদ্ধ) গৃহত্যাগ করতো না! সবচেয়ে ভালো পরিবেশও যখন একজন মানুষকে শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে না, তখন খারাপ পরিবেশে কি ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে সেটা ভাবা উচিত নয় কি?

.

আমি আমার দেশের অবস্থাই বিবেচনা করি! তৃতীয় বিশ্বের দূর্নীতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে পরিপূর্ণ এ দেশে যেখানে সমাজ শোষক আর শোষিতে বিভক্ত, সেখানে আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না আপনার সন্তান শোষক কিংবা শোষিত কোনোটাই হোক! একটা প্রশ্ন করি, আপনার ছোটবেলায় কি হতে চেয়েছেন সেটা যদি লিখে রাখতেন আর আজ কি হতে পেরেছেন সেটা যদি মিলিয়ে দেখেন, তাহলে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তিতে কতোটা মিল খুঁজে পাবেন? আপনি যদি ব্যর্থদের তালিকায় থাকেন তাহলে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তিতে আকাশ-পাতাল তফাত খুঁজে পাবেন আর যদি সফলদের তালিকায়ও থাকেন পরিপূর্ণ সৎভাবে বলতে পারবেন না আপনার এই সমাজব্যবস্থার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই! তাহলে, আমরা কেন আমাদের নতুন প্রজন্মকে জন্ম দেয়ার আগে এই সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন করছি না? যদি সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন আমাদের অসম্ভব মনে হয়, তাহলে কেন নিজেদের ব্যর্থতার ফলে এমন একটি সমাজব্যবস্থায় একটি সন্তানকে আনবো যে সমাজব্যবস্থা নিয়ে আমি নিজেই হতাশ?

.

জীবনবোধের সাথে সম্পর্কহীন শিক্ষাব্যবস্থা, একটা মেয়ের জন্য অনিরাপদ শৈশব, সর্বত্র অনিয়ম, মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চনা, অন্যের ক্ষতি না করে সৎভাবে পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন ব্যবস্থার অভাব, অযৌক্তিক ধর্মের দাদাগিরিসহ অনেককিছুই এ সমাজে জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুর উপর চাপানো হচ্ছে যা নিয়ে জন্মদাতা মানুষগুলোও বিরক্ত, হতাশ! আগেই বলেছি এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানোর আগে আপনি সন্তান জন্ম দেয়ার কথা ভাবারও নৈতিক অধিকার রাখেন না!


জন্মদানবিরোধ - ৮

.

['শিশুকামীরা শিশুদের সোজা অর্থে ধর্ষণ করে আর জন্মদাতারা রূপকার্থে! দুটো ক্ষেত্রেই এর ফল ভুগতে হয় সারাজীবন আর মানসিক যন্ত্রণা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত থাকে!' কথাটি যদিও একটি কুযুক্তি, (কেননা একটি জঘন্য অপরাধের সাথে অন্য কর্মকাণ্ডের তুলনা করলে জঘন্য অপরাধটিকে খাটো করা হয়) তবুও কিছু বিষয় একেবারে না ভাবলেও চলে না!]

.

প্রথমত, একজন শিশু যৌন নিপীড়ককে কেউ জন্ম দেয় না, সে আকাশ থেকে পড়ে - এটা নিশ্চয়ই আপনি মনে করেন না? আপনি হয়তো বলতে পারেন, কেউ 'শিশু যৌন নিপীড়ক' হয়ে উঠবে ভেবে সন্তান জন্ম দেয় না! তাহলে কিভাবে একজন শিশু যৌন নিপীড়ক হিসেবে গড়ে উঠে? 'একজন' বললে আসলে ব্যাপারটা খাটো করা হয়, এদেশের কথা বিবেচনা করলেও শিশু যৌন নিপীড়কের সংখ্যাটা বিশাল! (সারা পৃথিবীতে, এমনকি উন্নত দেশেও সংখ্যাটা ভয়াবহ) এই বিশাল পরিমাণ মানুষ শিশু যৌন নিপীড়ক হয়ে ওঠাকে নিশ্চয়ই আপনি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চাইবেন না?

.

একজন মানুষ বিভিন্ন কারণে অপরাধী হয়ে উঠতে পারে! যারা আত্মসমালোচনা করতে অনিচ্ছুক তারা হয়তো অপরাধীর জন্মের পেছনে বংশগতির প্রভাব অস্বীকার করতে চাইবে, কিন্তু পিতামাতার আচরণের সাথে মিল আছে বলেই প্রায়ই 'রক্তের দোষ' বলে একটা কথা বলা হয়! সরাসরি জন্মগত না হলেও শিশুর বিকাশকালীন সময়ে শিশুর অনুকরণশীল বৈশিষ্ট্যের জন্য পিতামাতার অনেক খারাপ বৈশিষ্ট্য সন্তান পায়। সেসব অস্বীকার করলে, বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়। দায় এড়িয়ে কোনো সমস্যার সমাধান আশা করা বোকামো।

.

আপনি যদি নিশ্চিত হয়ে থাকেন যে আপনার মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য ছিলো না, তাহলে সন্তানের মধ্যে এটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যের থেকে শিখেই আসবে। আপনি সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দিতে না পারা কিংবা আগলে রাখার ব্যর্থতা অস্বীকার করলেই বাস্তবতা বদলে যায় না! কিছু ক্ষেত্রে শোনা যায়, অন্যের হাতে নিপীড়নের শিকার হয়ে পরবর্তীতে কেউ কেউ নিজেই যৌন নিপীড়ক হয়ে উঠছে! (এটাকে সম্ভবত স্যাডিজম বলা যায়, যদিও অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দলাভকে স্যাডিজম বলা হয়) এক্ষেত্রে আপনার দায় দ্বিগুণ, আপনি সন্তানকে নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি আবার নিপীড়ক হয়ে ওঠা আটকাতে পারেননি। আর আপনি যদি দাবি করেন, আপনার নিজের কোনো ত্রুটি ছিলো না, আপনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরেও শিশুকে রক্ষা বা যৌন নিপীড়ক হয়ে ওঠা আটকানো সম্ভব হয়নি (অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় শিশু যৌন নিপীড়নকারীদেরকে তাদের বাবা-মা একেবারে নিষ্পাপ মনে করে, নিজেরাই জানতে পারে না তাদের অগোচরে কি জঘন্য মানসিকতা গড়ে উঠেছে সন্তানের) , তাহলে কেন এত অনিশ্চয়তা নিয়ে কাউকে জন্ম দিচ্ছেন?  

.

এবার আসুন, কিভাবে জন্মদাতারা রূপকার্থে শিশু নিপীড়ক? একজন শিশু নিপীড়ক কেবল তার স্বার্থের কথা ভাবে, এর ফলে ভিক্টিম শিশুর উপর কি ভয়াবহ প্রভাব পড়বে তা ভাবে না, কতজন জন্মদাতা সন্তান জন্ম দেয়ার সময় শিশুর উপর সারাজীবন কি কি যন্ত্রণা আসতে পারে সেটার কথা ভাবে? (শিশুকে নিজের ইচ্ছে ও স্বপ্ন পূরণের, একাকীত্ব দূর করার যন্ত্র ভাবা বিশাল সংখ্যক বাবা-মায়ের কথা নাইবা বললাম!) একজন শিশু নিপীড়ক শিশুকে নিপীড়নের জন্য বেছে নেয় কেননা শিশু শক্ত প্রতিবাদ করতে জানে না, ভয় পায়! একজন শিশুকে জন্ম দেয়ার সময় শিশু মোটেই প্রতিবাদ জানাতে পারে না, একজন শিশুকে পুতুলের মতো বাবা-মা যেমন নাচায় তেমন নাচতে শিশুটি অস্বীকৃতি জানাতে পারে না, তার অনিচ্ছা থাকলেও সে প্রতিবাদ জানাতে পারে না, মুক্তি লাভ করার উপায় থাকে না, বাবা-মায়ের মারধোর - বকাঝকার জন্য ভয়ে মুখ ফুটে তার ইচ্ছের কথা, যন্ত্রণার কথা জানাতে পারে না। (অনেক বাবা-মা তো 'আমি একবার চোখ বড় করলেই ভয় পেয়ে যায়', 'আমি ডানে যেতে বললে ডানে যায়' এমন জঘন্য নিপীড়নের কথা বলে গর্ববোধও করে!)

.

একজন যৌন নিপীড়ক শিশুকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে, বিভিন্ন কথায় মানসিক প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তার স্বার্থ আদায় করে! বাবা-মা সন্তানকে তার ইচ্ছের মতো করে গড়ে তুলতে এটা-ওটা দেয়ার লোভ দেখায়, আবার কিছু হলেই সন্তানের তার প্রতি আবেগী নির্ভরশীলতাকে ব্যবহার করে আবেগী ব্ল্যাকমেইলিংয়েরও আশ্রয় নেয়! একজন শিশু নিপীড়ক তার ব্যক্তিগত জীবনের হতাশা, অপ্রাপ্তি এর সাথে সংশ্লিষ্টতাহীন শিশুর উপর চাপায়! বাবা-মা তাদের সাংসারিক, দাম্পত্য, সমাজিক, কর্মস্থলের নানা হতাশা, অপ্রাপ্তি কি সন্তানের উপর চাপায় না? অনেক বাবা-মা সন্তানের মাধ্যমে বেহেশত লাভের লোভে সন্তানকে কওমী মাদ্রাসায় দেয়, আত্মীয়-প্রতিবেশীর সাথে ঝামেলা এড়াতে সন্তান তাদের কারো হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হলেও সেটা চেপে যেতে বলে, এরপরেও এমন বাবা-মাকে 'নিঃস্বার্থ' বলা যায় কি?

.

একজন যৌন নিপীড়কের তুচ্ছ স্বার্থে একটা শিশু সারাজীবন মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যায়, অনেকে কোনোভাবেই বের হতে পারে না। বাবা-মা একটা শিশুকে জন্ম দেয়ার পর যেসব যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, মৃত্যু ছাড়া সেসব থেকে স্থায়ী মুক্তি পাওয়া সম্ভব কি?

জন্মদানবিরোধ - ৯

.

অনেকেই ভাবেন, আমার সন্তান না থাকলে বৃদ্ধ কালে আমাকে কে দেখবে? বৃদ্ধ কালে আমি একা হয়ে যাবো! কিন্তু একটা কঠিন বাস্তবতা হলো যত চেষ্টাই করা হোক, বৃদ্ধকালে মানুষ একা হয়ে যায়! মানুষ অন্য মানুষের অভাবে একা হয় না, মানুষ একা হয় তার মনের কথা শুনে উপলব্ধি করবে এমন মানুষের অভাবে! অথচ জীবন চলার পথে মানুষ এমন মানুষগুলোকেই হারিয়ে ফেলে! আর আপনি যদি এমন সৌভাগ্যবান হয়ে থাকেন যে আপনার মনের মানুষ বেঁচে থাকবে আপনার সাথে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত, তাহলে আপনি বৃদ্ধ কালের একাকীত্ব থেকে রক্ষা পাবেন। আপনার সন্তান ভিন্ন যুগের, ভিন্ন বয়সের মানুষ, সে কেবল আপনার অসহায় অবস্থায় সেবা করে যেতে পারবে, আপনার একাকীত্ব দূর করতে পারবে না! আর মানুষ একা হয়ে পড়লে কিছু বুঝতে চায় না, আপনার সন্তানের জীবনে আপনিই একমাত্র ব্যক্তি নন, তবুও মন চাইবে সে কেবল আপনার পাশেই থাকুক সবসময়!

.

এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, আপনি বৃদ্ধকালে অসহায় হয়ে পড়বেন, সেজন্য সন্তানের সেবার প্রয়োজন হবে, ঠিক একইভাবে আপনার সন্তানও বৃদ্ধ হবে, তারও সেবার জন্য সন্তান প্রয়োজন হবে, এভাবে চলতেই থাকবে। এভাবে কিন্তু কোনো সমস্যার সমাধান হয় না, অনন্ত চক্র কোনো সমাধান নয়! আপনি আপনার অসহায়ত্ব আরেকজনের উপর চাপাচ্ছেন, সমাধান করছেন না! আপনাকে আপনার বাবা-মা আপনি না চাইতেও কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছে, সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে আপনি বৃদ্ধ বয়সে তাদের সেবা করবেন এটা ভালো কথা কিন্তু কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে আপনিও সন্তান জন্ম দিয়ে নিজের অসহায় সময়ের সহায় হওয়ার জন্য একটি নতুন জীবন তৈরির বাধ্যবাধকতা আপনার আদৌ আছে কি? এর চেয়ে আপনার অনাগত সন্তানকে এই অসহায়ত্ব-একাকীত্ব-যন্ত্রণার চক্র থেকে মুক্তি দেয়ার কথা ভাবাই কি উত্তম নয়? বৃদ্ধকালীন অসহায়ত্বের সহায় হিসেবে সন্তান জন্মদান সমাধান হলে পৃথিবীতে এত বৃদ্ধাশ্রম থাকতো না, এত পরিবারে বাবা-মা অবহেলা পেতে হতো না! আবার যাদের সন্তান হয় না কিংবা যারা বৃদ্ধ হওয়ার আগেই তাদের সন্তান মারা যায় তাদের ক্ষেত্রেও জন্মদান বৃদ্ধকালীন অসহায়ত্বের সমাধান হতে পারে না!

.

জন্ম দিলেই, উপযুক্ত শিক্ষা দিলেই সন্তান বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবাকে দেখাশোনা করবে, এমনটা কি সবসময় হয়? কোনো বাবা-মা ই কি তার সন্তানকে শিক্ষা দেয় বৃদ্ধ বয়সে তাকে অবহেলা করতে? বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে যে নিবেদিতপ্রাণ মানুষেরা বৃদ্ধদের সাহায্য করে তারা কি তাদের সন্তান? তাহলে বৃদ্ধ বয়সে সেবা পাওয়ার জন্য সন্তান হতেই হবে এমনটা আবশ্যক কি? বরং সন্তান থাকার পরেও বৃদ্ধ বয়সে অবহেলা পাওয়া, বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে বাধ্য হওয়া, একাকীত্ব এসব অনেক বেশি যন্ত্রণা দেয়, বৃদ্ধাশ্রমে পরম যত্নে রাখা হলেও তাই এসব লোকদের অন্তর প্রতিনিয়ত কাঁদে!

.

আসলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা আমাদের এ সর্বনাশের মূলে রয়েছে। আপনি যদি শিশুদের ভালোবাসেন, তাহলে অনাথ একটি শিশুর কেন দায়িত্ব নিচ্ছেন না? নিজেই নতুন একটি শিশুর জন্ম দিতে হবে কেন? আপনার সন্তানের যত্ন প্রয়োজন হলে, অনাথ শিশুটির কি যত্নের প্রয়োজন নেই? একটি শিশুর দায়িত্ব নিলে, তাকে ভালোবাসলে, সে কি বিনিময়ে আপনাকে ভালোবাসবে না, আপনার পাশে থাকবে না? আর থাকতেই বা হবে কেন? নিঃস্বার্থভাবে কারো জন্য কিছু করতে পারার আনন্দই কম প্রাপ্তি কোথায়? পৃথিবীতে কোটি কোটি শিশু আশ্রয়হীন, অনাদরে বেড়ে উঠছে, তাদের কথা একদম না ভেবে নতুন একটি শিশুর জন্ম দেয়ায় নিঃস্বার্থতা কোথায়? বিদ্যমান দুঃখ দূর করার আগে নতুন করে সুখের অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও শিশু জন্ম দেয়া কেবল চোখ বন্ধ করে নিজের স্বার্থের কথা ভাবার মতোই! (নিজের সন্তানের স্বার্থও নয়, কেননা অস্তিত্বহীন কারো স্বার্থ থাকে না।)

.

বিচার প্রক্রিয়ায় একটা কথা বলা হয়, 'হাজার অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক, তবু যেন একজনও নিরপরাধী শাস্তি না পায়!' তেমনি কোটি কোটি সন্তান যাদের অস্তিত্ব নেই কিন্তু জন্ম নিলে সুখী হতো, তাদের জন্ম না হলেও কিছুই যায় আসেনা কিন্তু একটি সন্তানকেও বিনা অপরাধে (পূর্বজন্মের পাপ নামক গাঁজাখোরী তত্ত্বের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই) অস্তিত্বের যন্ত্রণা ভোগ করতে জন্ম দেয়া নৈতিক হতে পারে না।

জন্মদানবিরোধ - ১০

.

জন্মদানের বিরোধিতা করলে সবচেয়ে বেশি যেটা শুনতে হয় সেটা হচ্ছে, 'জীবন যদি এতই যন্ত্রণার হয়, আর আপনি যদি সন্তান না রাখতে চান, তাহলে আপনি এখনই মরে যাচ্ছেন না কেন?' জন্মদানবিরোধ আর আত্মহত্যার সমর্থন এক নয়! জন্মদানবিরোধের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। আপনি নিজে না চাইলেও জীবন পেয়েছেন আর সে জীবনে নিজের সাথে জড়িয়ে ফেলেছেন আরো অনেকের জীবন, এ মুহূর্তে আপনি মরে যাওয়া আপনার প্রিয়জনদের যন্ত্রণা দিবে, সেটা স্বেচ্ছায় করা জন্মদানবিরোধের সাথে সাংঘর্ষিক! 

আপনি হয়তো বলবেন, জীবনকে এত যন্ত্রণার মনে করার পরেও যে মরতে চাইছেন না, এটাও কি প্রমাণ করে না বেঁচে থাকা আকাঙ্ক্ষিত? আপনাকে এটা বুঝতে হলে ভাবতে হবে জহির রায়হানের উপন্যাস 'হাজার বছর ধরে'তে বউ পেটানো আবুলের বউ প্রতিনিয়ত নির্মমভাবে মার খেয়েও গলায় ফাঁস দিতে গিয়েও কেন দেয় না? আমরা জৈবিকভাবে এমনভাবে গড়ে উঠেছি যে আমাদের কেবল ইতিবাচক ব্যাপারগুলো মনে থাকে, নেতিবাচকতাকে ভুলে অন্ধ প্রকৃতির আরোপিত বংশ রক্ষার দায়িত্ব পালনই স্বাভাবিক মনে হয়, জীবনের যন্ত্রণা আমাদের বিবেচনায় আসে না! (যদিও জীবনের জটিলতাকে নেতিবাচকও বলা যায়, আমরা আমাদের অনেক ইতিবাচক ব্যাপার থাকার পরেও নেতিবাচক তুচ্ছ ব্যাপার নিয়েই হতাশা,যন্ত্রণায় ভুগি!)

.

জন্মদানবিরোধী অনেকের কথা বলার ধরনে মনে হয়, জীবনে কেবল যন্ত্রণা-ভোগান্তিই আছে, কোনো সুখ নেই! কিন্তু বাস্তবতা তো সেটা নয়, যন্ত্রণার পাশাপাশি প্রত্যেক মানুষের জীবনে অল্প হোক বা বেশি, সুখ থাকেই। যদিও কিছু দুঃখ - যন্ত্রণার সমস্ত সুখ মাটি করার ক্ষমতা থাকে, কিছু যন্ত্রণা এড়ানোর উপায় থাকে না এবং সুখ খুব কম ক্ষেত্রেই দীর্ঘস্থায়ী হয়! আমাদের অনেকেই নিজেদের পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে সান্ত্বনা হিসেবে বলি সুখে আছি কিংবা আমার চেয়েও কষ্টে আছে এমন কাউকে দেখে (জঘন্য)  আপেক্ষিক সুখ-বিভ্রমে ভুগি! এসবকিছু বাদ দিয়ে যদি ভাবি আমার জীবন পরিপূর্ণ সুখী, তবুও সন্তান জন্ম দেয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা আমার নেই কেননা যার অস্তিত্ব নেই তাকে অস্তিত্বে না আনা কোনোভাবেই খারাপ নয় বরং জীবনের জটিলতা-যন্ত্রণার কথা বিবেচনা করলে এমন সিদ্ধান্ত নেয়াটা ভালো বটে!

.

জন্মদানবিরোধ যেহেতু যন্ত্রণা এড়ানোর জন্যে করা হয় তাই প্রশ্ন আসবেই অন্যান্য অনুভূতিশীল প্রাণীকে জীবনযন্ত্রণা থেকে কে মুক্তি দিবে? একটা হরিণকে জীবিত অবস্থায় যন্ত্রণা দিয়ে বাঘ খাবে, সে যন্ত্রণা থেকে তাকে কে মুক্তি দিবে? সে বিষয়ে ভাবা যেতে পারে কিন্তু সত্য হলো এই যে, এ পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে প্রাণীদের যে যন্ত্রণা পেতে হয়, তার চেয়ে বহুগুণ নির্মম যন্ত্রণা মানুষের হাতেই পেতে হয়! তাই, মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি না করা সার্বিকভাবে কোনো খারাপ সিদ্ধান্ত নয়! জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ পৃথিবীতে নতুন জনসংখ্যা যোগ না করাই হতে পারে পৃথিবীর আলো-জল-মাটিতে বেড়ে ওঠার কৃতজ্ঞতার প্রকাশ!

.

অনেকে বলবেন জন্মদান প্রাকৃতিক, জন্মদানের বিরোধিতা করা অপ্রাকৃতিক! অথচ তারা নিজেরাও জানে বছর বছর একের পর এক বাচ্চা জন্ম হওয়া প্রাকৃতিক কিন্তু তারাই জন্মবিরোধ-পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রকৃতির বিরোধিতা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত! কেবল নিজের স্বার্থে যখন সন্তান নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তখনই তারা প্রকৃতিপুজক হয়ে যান! প্রকৃতি শুধু মানুষকে জন্মদানের ক্ষমতা দেয়নি, সেটা রোধ করার উপায় বের করার মতো এবং জন্ম দেয়ার নৈতিকতা সহ অন্যান্য দিক ভাবার মতো মস্তিষ্কও দিয়েছেন। প্রকৃতির দান মস্তিষ্ক ব্যবহার করে প্রকৃতির জন্মচক্রের বিরোধিতা অনেকটা রাজা হিসেবে শোষণের উত্তরাধিকার পেয়েও শোষণের রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘোষণা করারই মতো!

.

আমি যে এত কথা বলছি সেটা আমার পরিস্থিতি, অতীত, বর্তমান, উপলব্ধি সহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে একপাক্ষিক/ভুল হতেও পারে! কিন্তু জন্মদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু হলেও ভাবা উচিত সবারই! মস্তিষ্কের ব্যবহার না করে কেবল নিজ স্বার্থে, সমাজের কথা শোনার ভয়ে জন্মদান মানুষের মস্তিষ্কেরই অপমান!

পর্ব -১১

স্বাধীনতা, আত্মহত্যা, ধর্ম ও জন্মদানবিরোধ! 

.

মানুষ কি স্বাধীন? এ প্রশ্ন অনাদিকাল থেকে বিতর্কের বিষয়, যদিও মূল বিতর্ক ঈশ্বরের অধীন কিনা তা নিয়ে। কিন্তু আমরা ধরে নিই ঈশ্বর বলে কিছু নেই, তাহলে কি মানুষ স্বাধীন? কিছু কিছু মানুষ বলে আমি স্বাধীন, কিন্তু আসলেই কি একটা মানুষ কোনোভাবে স্বাধীন হতে পারে? একটা মানুষ জন্ম নেয় অন্যের ইচ্ছায়, যার জন্মই তার অধীনে নেই সে নিজেকে স্বাধীন বলা তার অজ্ঞতা কিংবা ভন্ডামী! মানুষের (আত্মহত্যা ছাড়া) মৃত্যু কি তার অধীন? আত্মহত্যাটাও কি মানুষের অধীন? মানুষের জৈবিক সংগঠন তাকে সব কষ্ট সয়েও বাঁচিয়ে রাখতে চায় আবার সমাজ ও আশেপাশের মানুষগুলো ও পরিস্থিতি আত্মহত্যায় বাধ্য করে, তাহলে আত্মহত্যাটাই নিজের অধীন কোথায়? জন্ম-মৃত্যু আপনার অধীন নয়, বাকী জীবনটা কি তাহলে আপনার অধীন? আপনি কি জানেন কেবলমাত্র আপনার জন্মটাই আপনার জীবনের বড় একটা অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে? কেমন পরিবারে-সমাজে-দেশে-ধর্মে জন্মেছেন, বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা, প্রতিবেশী - আত্মীয়রা কেমন, আপনার নিজের চেহারা-দৈহিক সামগ্রিক গড়ন-মস্তিষ্কের ক্ষমতা-জেনেটিক বৈশিষ্ট্য কেমন এসবকিছুই আপনার জীবনকে প্রচন্ডভাবে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করতে পারে। আপনি হয়তো সবকিছু ছেড়ে নিজে আত্মকেন্দ্রিক সন্ন্যাস নিয়ে সুখ পাওয়ার কথা ভাবতে পারেন কিন্তু আপনাকে মানতে হবে সেটা আপনি প্রকৃতি ও প্রচলিত ধারাকে অস্বীকার করেই করছেন! তাহলে কেন সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো অনৈতিক কাজটি থেকে প্রকৃতিকে অস্বীকার করে বিরত থাকতে পারবেন না? নিজে পরাধীন বুঝতে পারার পরেও আরেকজনকে পরাধীনতার জীবন দিয়ে যন্ত্রণা দেয়া নৈতিক হয় কিভাবে? 

.

এবার ধরুন আপনি পৃথিবীর মোটামুটি একটা ভালো পরিবারে জন্মেছেন, তাহলেই কি আপনি স্বাধীন?  আপনি কি চাইলেই নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকতে পারবেন? কিংবা না খেয়ে? কিংবা একেবারেই না ঘুমিয়ে? কেন খাওয়া ও নিঃশ্বাসের প্রসঙ্গ আনলাম? আমরা অধিকাংশ মানুষ আমাদের জীবনের বড় সময় বাধ্য হয়েই ব্যয় করি বেঁচে থাকার জন্য খাবার কেনার টাকা উপার্জনে ও ঘুমে! (যদিও পুঁজিবাদ ও ভোগবাদের খপ্পরে পড়ে মানুষের জীবন আরো অনেক বেশি জটিল হয়েছে!) আর নিঃশ্বাসের প্রসঙ্গ কেন আনলাম? এটা তারা সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝবেন যারা দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসকষ্টে ভুগে প্রতিটি নিঃশ্বাসের জন্য কলজে-ছেঁড়া যন্ত্রণা সয়ে সংগ্রাম করতে হয়। এ লোকগুলোর জন্য কি সমাধান দিবেন? যন্ত্রণার কারণ অর্থাৎ শ্বাস নেয়া বন্ধ করা? প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত যৌন আকর্ষণের ফলে সৃষ্ট প্রেম কেন্দ্রিক জটিলতাসহ অন্যান্য জটিলতার কথা নাইবা আনলাম! এতকিছুর পরেও নিজেকে স্বাধীন মনে করা লোকগুলোকে ভন্ড না বললেও অন্তত সৎ/জ্ঞানী বলা যায় না!

.

জীবনের এই জটিলতার, পরাধীনতার সমাধান কি তাহলে আত্মহত্যা? কেউ কেউ পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাধীনতার অভাব, যন্ত্রণা এসব হচ্ছে আত্মহত্যার কারণ, তাই জীবনের এসব যন্ত্রণার ধারণা ছুঁড়ে ফেলে নতুন করে স্বাধীন জীবন শুরু করাটাই সমাধান।  কিন্তু তারা এই সত্যটি অস্বীকার করছে যে এত জটিলতা, এত যন্ত্রণার মূল কারণ জীবন, জীবন থাকলে যন্ত্রণা,জটিলতা থাকবে, আপনি শুধুমাত্র নিজের সাথে মিথ্যা বলে, আত্মপ্রতারণার মাধ্যমে সেসব অস্বীকার করতে পারেন! এখানে আরো একটি সমস্যা হচ্ছে,  একজন মানুষ তার জীবনকে নতুন করে শুরু করে সমাধান পেয়েছে বলে অন্যরাও পাবে এমন নয়, একজন নিজের জীবন নতুন করে শুরু করতে পেরেছে বলেই অন্যরাও পারবে এমনটাও নয়, কেননা সবার পরিস্থিতি, সক্ষমতা এক থাকে না! তাহলে আমি যে বলেছি আত্মহত্যা প্রতিরোধ সমাধান, সেটা কিভাবে? আপনি নিজে জীবন যন্ত্রণা অনেক চেষ্টায় এড়িয়ে আত্মহত্যা থেকে রক্ষা পেলেন, কিন্তু আপনি সন্তান জন্ম দিলে সে সন্তান যে জটিলতায় পড়ে আত্মহত্যা করবে না সে নিশ্চয়তা কোথায়?

.

পৃথিবীতে কিছু সহজ সত্য অস্বীকার করি বলেই যুগে যুগে আমরা জটিলতা সৃষ্টি করেছি। মৃত্যুর পরে আমাদের চেতনার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না এই সহজ সত্য মানতে পারিনি বলেই যুগে যুগে অন্ধবিশ্বাস - গোঁড়া ধর্ম গড়ে উঠেছে। তেমনি মানুষের অস্তিত্ব না থাকলে কিছুই আসবে যাবে না এত সহজ সত্য আমরা স্বীকার করি না। হারারি স্যারের মতো একজন জ্ঞানী মানুষও জীবনের অর্থ নেই স্বীকার করলেও জন্মদানের বিরোধিতা করেননি কেননা মানুষের কাছে ধর্মের চেয়েও জন্মদানের প্রবৃত্তির দাসত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সেটা অস্বীকার করে জনপ্রিয়তা অর্জন সম্ভব নয় বললেই চলে! আগের যুগে অনেক জমিদার তার সম্পত্তি মৃত্যুর পরে কে ভোগ করবে সেটা ভেবে সন্তান জন্ম দেয়াকে গুরুত্ব দিতো, কিন্তু সে জমিদারের মৃত্যুর পর তার সন্তানরা যে বছর কয়েকের মধ্যে খামখেয়ালি করে সব সম্পত্তি হারিয়ে পথে বসবে না এমন নিশ্চয়তা ছিলো কি?

.

পুঁজিবাদ বলেন, সমাজতন্ত্র বলেন, ধর্ম বলেন এরা মানুষ চায়, কেননা মানুষ ছাড়া কোনো তন্ত্র বা ধর্মই টিকে থাকবে না, সেজন্য ধর্ম ও বিভিন্ন তন্ত্রের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সন্তান জন্ম দিলে ইহকালীন ও পরকালীন নানা সুবিধাপ্রাপ্তির বর্ণনা রয়েছে। পুঁজিপতিরা মানুষ চায় দাস হিসেবে, বর্তমান চাকরি ব্যবস্থায় যত লোভনীয় বেতন আর সুবিধাই থাক, একজন চাকরিজীবী পুঁজিপতিদের দাস ছাড়া কিছুই নয় যারা পরোক্ষভাবে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টিতে সহায়তা করে যাচ্ছে ! তাই পুঁজিবাদ অপছন্দ করা একটা মানুষ পুঁজিবাদী সমাজে একটি শিশুর জন্ম দেয়া আসলে পুঁজিবাদের দাসের জন্ম দেয়া। অনেকে ভাববেন সমাজতন্ত্র তো ভালো ব্যাপার কিন্তু বাস্তবতা হলো সমাজতন্ত্র কখনোই মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবেনি, শ্রেণীশত্রু খতমের জটিলতায় নাইবা গেলাম, সমাজতন্ত্র মানুষকে উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবেই বিবেচনা করে আর কঠোর নিয়ন্ত্রণ, স্বাধীনতা হরণ ছাড়া কোথাও সমাজতন্ত্র বাস্তবায়িত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে বাচ্চা জন্ম না দিলে আলাদা কর দিতে বাধ্য করার ইতিহাসও ভাবার মতোই!

.

অনেকে হয়তো ভাববেন যারা ধর্মে বিশ্বাস করে না জন্মদানবিরোধ তো কেবল তাদের জন্যই। কিন্তু আসলেই কি তা? ধর্ম সন্তান জন্মদানে উৎসাহ দিলেও কেউ সন্তান জন্ম না দিলে জাহান্নামে/নরকে যাবে এমনটা কোথাও বলেছে? বরং আপনি ধর্মবিশ্বাসী হলেও আপনার সন্তান জন্ম না দেয়াই উচিত।  আপনি নিশ্চয়ই জানেন মানুষ মাত্রই পাপ করে আর ছোটোখাটো পাপেও জাহান্নামে  কতো কঠোর শাস্তি পাওয়ার কথা বলা আছে, এজন্য দেখবেন সন্তান নামাজ না পড়লে বাবা মা সন্তান জাহান্নামে যাবে ভেবে আবেগী হয়ে পড়ে! শুধু কি তাই?  সন্তান পাপী হলে তার জন্য  বাবা মাকেও জবাবদিহি করতে হবে এই ভয়ে অনেক বাবা-মা সন্তানকে ধর্ম পালনে জোরও করেন, সেটা কি নৈতিক কাজ হয়? অনেক পরিবারেই শত চেষ্টার ফলেও সন্তান ধর্ম মানে না, তখন সন্তানকে জাহান্নামে জ্বলতেই হবে। কিন্তু সন্তান জন্ম না দিলে অন্তত সন্তান জাহান্নামে জ্বলবে ভয় তো থাকবেই না উপরন্তু সন্তানকে ধর্মের পথে রাখতে না পারার জন্য জবাবদিহিও করতে হবে না। তাই ধর্মবিশ্বাসীরা নিজের বিশ্বাস থেকে নিজের ও সন্তানের ভালো যদি আসলেই চায় তাহলে তাদেরও উচিত হবে সন্তান জন্ম না দেয়া!

কেননা সন্তান জন্ম দেয়ার পর আপনার শত চেষ্টার পরেও সন্তান ভালো না হলে, 'এর চেয়ে যদি আমার সন্তানই না থাকতো!' বলে আফসোস করা ছাড়া কিছুই  করার থাকবে না!

জন্মদানবিরোধ কি জীবনের অবমূল্যায়ন?

.

'জীবন সুন্দর!' অথচ জন্মদানবিরোধীরা কেবল জীবনের খারাপ দিকটাই তুলে ধরে জীবনের অবমূল্যায়ন করে! - জন্মদানের পক্ষে থাকা লোকদের থেকে প্রায়ই এমন কথা শোনা যায়!

.

আজ বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস! কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, আমরা আত্মহত্যা প্রতিরোধের কথা যতটা বলি, আত্মহত্যার কারণগুলি দূর করতে বা সেসব নিয়ে ভাবতে মোটেই সদিচ্ছা দেখাই না! কেউ একজন আত্মহত্যা করলে গুটিকয়েক লোক ছাড়া অধিকাংশই বলে 'লোকটা কাপুরুষ'/'এত তুচ্ছ কারণে মারা গেলো'/ 'জীবন কত সুন্দর বুঝলো না', 'জীবনের মূল্য বুঝলো না'! অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষই মনে করে কারো পক্ষে জীবনের অবমূল্যায়ন করা সম্ভব!  কিন্তু তারা মূদ্রার অপর পিঠ নিয়ে ভাবতে একদমই নারাজ! জীবনের যদি অবমূল্যায়ন সম্ভব হয় তাহলে তো জীবনের অতি মূল্যায়নও সম্ভব। আমরা যেহেতু জৈবিকভাবে টিকে থাকা ও বংশধর রাখার অন্ধ দাসত্বে বন্দি, সেখানে জীবনের অতিমূল্যায়নই বরং স্বাভাবিক। তাই 'জীবন যন্ত্রণাময়' কথাটা জীবনের অবমূল্যায়ন হলে 'জীবন সুন্দর' কথাটা জীবনের অতিমূল্যায়ন!

.

আপনি হয়তো বলবেন আত্মহত্যা আর কয়জনই বা করে! গুটিকয়েক লোকের জীবনের অবমূল্যায়ন দিয়ে তো আপনি সবার জীবনকে মূল্যায়ন করতে পারেন না! অথচ বিশ্বে প্রতি বছর যুদ্ধ-জঙ্গী হামলা-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সব মিলিয়েও যত মানুষ মারা যায় না, তার চেয়ে বেশি মানুষ (প্রায় ১০ লাখ) আত্মহত্যা করে! আপনি নিশ্চয়ই মনে করেন না এ লোকগুলো 'জীবন সুন্দর' বুঝতে পেরে খুশিতে আত্মহত্যা করে‌!

কেবল এ বছর ৭৭ লক্ষ লোক না খেয়ে মারা গেছে, না খেয়ে মারা যাওয়ার কষ্ট আমরা কল্পনাও করতে পারবো? বিশ্বে ৮৪ কোটি লোক পুষ্টিহীনতায় ধুঁকে ধুঁকে বাঁচে, এদের জীবনকে আপনি সুন্দর বলবেন কেবল রেস্টুরেন্টে খেয়ে ছবি দেয়া কতিপয় স্বার্থপরকে দেখে? বিশ্বে ১০ কোটি মানুষকে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হয়, ১০০ কোটির বেশি মানুষের একটা ভালো থাকার ঘর নেই, আপনি এদের জীবনকে সুন্দর বলবেন কেবল গুটিকয়েক স্বার্থপর ধনীর বাড়ির বিলাসবহুল ইন্টেরিয়র ডিজাইন দেখে? বিশ্বে ৮০ কোটি লোক নিরাপদ পানি পায় না! আপনি তাদের জীবনকে সুন্দর বলবেন? (বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে পানির জন্য লাইন দিয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করা, গ্যাসের জন্য রান্না করতে না পারা মানুষগুলোর জীবন আপনার কাছে সুন্দর মনে হয়?) বিশ্বে প্রতি বছর ৫৭ লাখ লোক ক্যান্সারে সহ কোটি লোক যন্ত্রণাদায়ক রোগে ভুগে মারা যাচ্ছে, তাদের জীবনকে সুন্দর মনে হয় আপনার? যারা শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তাদের জীবন সুন্দর বলবেন শো-অফ করা কিছু স্বার্থপর মানুষের আপাতদৃশ্য সুখ দেখে? যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে যে মানুষগুলো প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ভয় সাথে নিয়ে বাঁচতে বাঁচতে মরে যাচ্ছে, চোখের সামনে যারা তরতাজা সন্তান, আত্মীয়কে মরতে দেখছে, তাদের জীবনকে সুন্দর বলবেন উৎসবে বিভোর কিছু স্বার্থপরকে দেখে?

 কতিপয় স্বার্থপর মানুষের প্রদর্শনকৃত জীবনকে দেখেই 'জীবন সুন্দর' বলে দিচ্ছেন? বিশ্বে ত্বকের কালো রংয়ের জন্য, শরীরের আকৃতিগত ত্রুটির জন্য নিগৃহীত হওয়া কোটি নারী-পুরুষের দুঃখ উপেক্ষা করে সুদর্শন কিছু নারী-পুরুষের আপাতদৃশ্য সুখী জীবন দেখেই জীবন সুন্দর বলছেন? আপনি অন্যদের চেয়ে সুখে আছেন, অর্থাৎ অন্যের কষ্ট দেখে সান্ত্বনা বা আনন্দ খোঁজার মতো নিকৃষ্ট মানসিকতা নিয়ে'জীবন সুন্দর' বলছেন? জানি, 'জীবন সুন্দর' না ভাবলে, সবার দুঃখ নিয়ে ভাবতে গেলে আপনি সহজভাবে বাঁচতে পারবেন না, কিন্তু 'জীবন সুন্দর' নামক মিথ্যাটা বলে নতুন কাউকে জীবন দেওয়া চরম স্বার্থপরতা ও ভন্ডামী ছাড়া তো কিছুই নয়!

.

যখন অধিকাংশ লোককে হাসির আড়ালে দুঃখ লুকাতে হয়, যখন বিশ্বের একটা বড় অংশ ডিপ্রেশনে ভোগে, তখনও বলবেন 'জীবন সুন্দর'? যখন গানে বলা হয়, 'আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি, তাই তোমার কাছেই ছুটে আসি' তখনও কি মনে হয় আসলেই কেউ কষ্ট পেতে ভালোবাসে? দুঃখ কেউই কি ইচ্ছে করে পেতে চায়? আপনার তাই মনে হয়? যদি তা মনে না হয় তাহলে যা মানুষ এড়াতে চায়, জীবনে সেটা পেতে বাধ্য হওয়াটা কি আসলেই খুব সুন্দর? 

.

আপনি নিজের অনিচ্ছাতেই জীবন পেয়েছেন,  সেটার অবমূল্যায়ন বা অতিমূল্যায়ন না করে সেটাকে কাজে লাগান। পারলে বিদ্যমান অন্য কারো জীবনের দুঃখ একটু লাঘব করার চেষ্টা করুন, সেটুকুও না পারলে অন্তত নতুন কারো কষ্টের কারণ হবেন না, এমনটাই তো হওয়া উচিত!

জন্মদানবিরোধ কি সমাধান? 

.

একটা ময়লা পরিপূর্ণ নদী বা একটা প্যাঁচ লেগে যাওয়া সুতার কথা চিন্তা করুন। আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, নদীতে নতুন করে ময়লা না ফেলা কিংবা সুতাটায় যাতে নতুন করে আরো প্যাঁচ না লেগে যায় সে চেষ্টা করা কি সমাধান?  আপনি কি জবাব দিবেন? হয়তো নতুন করে ময়লা না ফেলা একটি ময়লা পরিপূর্ণ নদীর জন্য কোনো সমাধান নয় কিন্তু এমনটা করা সমাধানের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর প্রথম আবশ্যক কাজ। ধরুন, আপনি আগের ময়লাগুলো পরিষ্কার করতে ব্যার্থ হলেন,  তবুও কি নতুন করে ময়লা না ফেলা ভালো পদক্ষেপ নয়? অন্যদিকে আপনি ময়লা ফেলতেই থাকলে সমস্যার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা তো থাকছেই না উপরন্তু সমস্যা বৃদ্ধি পাবে।

আপনি যদি বলেন উত্তরাধুনিকতার সংকট অত্যন্ত জটিল, সেটার সমাধান এত সহজ নয়, তাহলে আপনার ভাবা উচিত নতুন করে মানুষ বৃদ্ধি করা সে সংকট সমাধান করবে নাকি আরো ঘনীভূত করবে? জন্মদানবিরোধ সমাধান নয় কিন্তু সমাধানের পথে প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে। আপনি সমস্যা সমাধানের আগে নতুন কাউকে এই সমস্যায় ফেলে সমস্যাকে অন্তত ঘনীভূত করছেন না। আপনি যদি মনে করেন মনুষ্যসংখ্যাবৃদ্ধি কোনো সংকট সৃষ্টি করছে না তাহলে আপনি সততার সাথে ভাবছেন না!

.

দুইশত বছর আগের কথা ভাবুন, মানুষ তখনো প্লাস্টিকের ব্যবহার এমন অহরহ শুরু করেনি, অথচ আজ সমুদ্রের গভীরতম খাদও প্লাস্টিক দূষণের শিকার! আপনি কি ভাবছেন ৭০০ কোটি মানুষ সস্তা প্লাস্টিক ছেড়ে রাতারাতি পরিবেশবান্ধব হয়ে যাবে? আপনি কি ভাবছেন জনসংখ্যা বাড়াতে থাকবেন আর প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষ হবে না? পৃথিবীর পরিবেশ আরো দূষিত হবে না, বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ভবিষ্যতে কল্পনাতীত পরিণতি ভুগতে হবে না? জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে তাদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে পরিবেশ সংকট আরো তীব্র হবে এটা একেবারেই সহজ হিসেব! 

জ্যারেড ডায়মন্ড লিখেছিলেন এখনো কিছু উপজাতিদের মধ্যে সুন্দর, জটিলতাহীন সমাজব্যবস্থা দেখা যায়, এর প্রধানতম কারণ জনসংখ্যা কম হওয়া! তাই বর্তমান পৃথিবীর মানুষের জন্য কোনো সমাধানের কথা ভাবলে সেটা অতিরিক্ত জনসংখ্যার সমস্যা উপেক্ষা করে কতোটা সম্ভব জানা নেই!

.

জন্মদানবিরোধ আবেগ ছাড়া কিছুই নয়?

.

প্রথমে মেনে নিচ্ছি জন্মদানবিরোধ আবেগ। তবে সেটা  ইতিবাচক আবেগ। আপনি এক আবেগে কারো ক্ষতি করলেন আর আরেক আবেগে ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকলেন, দুটোকে এক মনে করা যায় কি? জন্মদান ব্যাপারটাও মানুষের আবেগ, সেখানে যাকে জন্ম দেয়া হয় তার স্বার্থের কথা না ভেবেই তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, যেটা নেতিবাচক। অন্যদিকে জন্ম দেয়া থেকে বিরত থাকলে জন্মদানবিরোধীদের মতে একজনকে সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষা করা হয়। কিন্তু সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে যার অস্তিত্ব নেই তার ভালো বা খারাপ হতে পারে না। সেটা মেনে নিলেও আপনি জন্ম দিলে একটু হলেও কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন যেখানে জন্ম না দিলে ক্ষতি বা উপকার কিছুই হচ্ছে না! যেখানে জন্ম দিলে একটু ক্ষতিরও সম্ভাবনা থাকে সেখানে জন্ম না দেয়া উত্তম নয় কি? বিদ্যমান মানুষদের সমস্যা নিয়ে ভেবে সমাধানের চেষ্টা করা, নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি না করার ব্যাপারে ভাবা মানুষের দায়িত্বের মধ্যে পড়লেও নতুন করে জন্ম দেয়া কারো দায়িত্ব হতে পারে না! ইমানুয়েল কান্টের মতে মানুষকে তার স্বার্থ ছাড়া কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার অনৈতিক, সেখানে একজন শিশুকে নিজের বংশধর রাখা, বাবা-মা হওয়ার ইচ্ছে পূরণ কিংবা সমাজের লোকদের কথা যেন না শুনতে হয় সে উদ্দেশ্যে জন্ম দেয়া কি অনৈতিক নয়? 

.

আপনি জন্ম না দিলেও অন্যরা জন্ম দিতেই থাকবে, তাহলে কি লাভ হলো?

.

পৃথিবীর সবাই অনৈতিক কাজ করছে বলে আপনি না করার কোনো গুরুত্বই নেই এটা আমি মানতে নারাজ! আপনি যে সমাজে বসবাস করছেন সে সমাজে সবাই অপকর্ম করলে আপনি সেসব অপকর্ম বন্ধ করতে না পারলে সে সমাজ ছেড়ে চলে যাওয়াটা নৈতিক দায়িত্ব হয়ে পড়ে। সবাই নতুন নতুন জীবনকে যন্ত্রণা ভোগের জন্য জন্ম দিলেও আপনি না দেয়াটা তেমনই নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আপনি আপনার নূন্যতম নৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন, সারা বিশ্বের সমস্যা সমাধানের সুযোগ আপনার হাতে নেই তাই সেটা আপনার দায়িত্বও নয়!

.

আমি এ বিষয় নিয়ে লেখা ও না লেখা একই কথা?

.

একটা মজার ব্যাপার হলো, আমার পাঠকদের অনেকেরই ভাবনার গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করে, আমি লিখলেও আসলে প্রতিনিয়ত তাদের থেকে শিখি। তাদের সাথে আমার সম্পর্ক প্রকাশের জন্যই কেবল 'পাঠক' শব্দটি ব্যবহার করি। আমার পাঠকদের বেশ কয়েকজন জন্মদানবিরোধের সমর্থক, আমি নিজেও। কারো মধ্যে উপলব্ধি আনার মতো করে লেখার জ্ঞান আমার নেই, কাউকে জন্মদানবিরোধের সমর্থক বানানোর ইচ্ছেও আমার নেই। আমার লিখতে ভালো লাগে জন্য যা কিছু ভাবি এই পেইজে লিখি রাখি, জন্মদানবিরোধও তেমনই লেখা!


সিসিফাস, অর্থহীন পুনরাবৃত্তি ও জন্মদানবিরোধ 

.

জন্মদানবিরোধের নৈতিক দিক নিয়ে কথা উঠলে প্রথমেই কনসেন্টের প্রসঙ্গ আসে। (যদিও কনসেন্ট থাকলেও সবকাজকে নৈতিক বলা যায় না আবার কনসেন্ট না থাকলেও সব কাজকে অনৈতিক বলা যায় না।) জন্মদানবিরোধ মানে যার অস্তিত্ব নেই তাকে নিয়ে কথা বলা, ফলে অস্তিত্বহীনের কনসেন্ট আছে কিনা জানার উপায় থাকে না। যেসব কাজ করার জন্য কনসেন্ট প্রয়োজন, সেসব কাজ না করার জন্যেও কি কনসেন্ট প্রয়োজন? 

ধরুন, জাহান্নাম সত্য এবং আপনি পৃথিবীতে জন্ম না নিয়ে জন্ম নিয়েছেন জাহান্নামে। জাহান্নামে তীব্র অসহ্য যন্ত্রণা সয়ে বেঁচে আছেন। এখন আপনার যদি সুযোগ থাকে সন্তান জন্ম দেবার, আপনি কি সন্তান জন্ম দিবেন? যদি আপনার জাহান্নামেও সন্তান জন্ম দেয়ার ইচ্ছে হয় তাহলে এই লেখা আপনার জন্য নয়! আর যদি আপনি সন্তান জন্ম না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে কেন কনসেন্ট জানা সম্ভব না হওয়া সত্ত্বেও আপনি জাহান্নামে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন না? কেন ভাবছেন না আপনার সন্তান তো জাহান্নামের জীবন উপভোগও করতে পারে, ভবিষ্যতে জাহান্নামের জীবন সুখেরও হতে পারে? কারণ আপনি আপনার অনাগত সন্তানকে ভালোবাসেন। আপনার অভিজ্ঞতা আপনাকে সন্তান জন্ম দিতে বাধা দিবে কেননা আপনি অনেকটা আপনার অনাগত সন্তানের জন্য দূত যে কিনা তার আগে এসে দেখছেন জাহান্নামটা সন্তানের আসার জন্য উপযুক্ত কিনা, উপযুক্ত না হওয়ার পরেও যদি তাকে জাহান্নামে জন্ম দেন তাহলে আপনি আপনার সন্তানের সাথে প্রতারণা করছেন। আপনার সন্তান যদি প্রশ্ন করে জীবন যন্ত্রণাময় হতে পারে জেনেও কেন জন্ম দিয়েছেন তাকে, কী জবাব দিবেন?

.

আপনি বলবেন আপনার সন্তান তো জাহান্নামে জন্ম নিচ্ছে না, পৃথিবীতে তো কেবল কষ্ট নেই, সুখও আছে! দাঁড়ান, নিজেকে প্রশ্ন করুন। পৃথিবীতে আসলেই সুখ আছে? সিসিফাসের প্রচলিত মিথ অনুযায়ী দেবতারা তাকে একই পাথর বারবার উঠানোর মতো নিরর্থক পুনরাবৃত্তিমূলক ও যন্ত্রণাদায়ক সাজা দিয়েছে কিন্তু সে কাজটি তাকে করতেই হলে এই নিরর্থকতায় সুখ খুঁজে সান্ত্বনা পাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমাদের জীবনও কি তেমন নিরর্থক পুনরাবৃত্তি নয়? এই সূর্যের নিচে লক্ষ কোটি বছর আগেও জীব খেয়েছে, ঘুমিয়েছে, রেচন, প্রজনন করেছে, আমরা সেসবের চেয়ে ভিন্ন কি করছি? আপনি মজা করে যে খাবার খাচ্ছেন, আরামে ঘুমাচ্ছেন, ভিআইপি ওয়াশরুমে রেচনকাজ করছেন, সেক্সের আনন্দানুভূতি লাভ করছেন, ঘুরেফিরে এগুলো বারবার করতে বাধ্য হচ্ছেন, এসব আসলে সিসিফাসের পাথর ঠেলে উপরে তোলার বাধ্যবাধকতায় সুখ খুঁজে পাওয়ার মতো নিরর্থকতার সুখ-ভ্রম ছাড়া কিছুই নয়। এই সুখ-ভ্রমে থাকা কেউ যে যন্ত্রণা ভোগে না এমন নয়, প্রতিটি সংবেদনশীল প্রাণীকে শারীরিক,মানসিক যন্ত্রণা ভুগতে হয়।

.

একজন জাহান্নামের অধিবাসী যে কারণে সন্তান জন্ম দিতে চাইবে না, সিসিফাসের সন্তান জন্ম দেয়া বা না দেয়ার সুযোগ থাকলে একই কারণে হয়তো সেও সন্তান জন্ম দিতে চাইতো না। যে নিরর্থক যন্ত্রণাদায়ক জীবনের শাস্তি ভুলতে সে সুখ-ভ্রমে সান্ত্বনা খোঁজে, সে কেন তেমন জীবন অন্য কাউকে চাপিয়ে দিবে? অথচ মানুষ জীবনের নিরর্থকতাকে যে কেবল যে সুখ-ভ্রমে ভুলে থাকে সেটাই নয়, একই নিরর্থক পুনরাবৃত্তির জীবন তার সন্তানের উপর অপরাধবোধ ছাড়াই চাপিয়ে দিচ্ছে। সিসিফাসের মতো যে নিরর্থক পুনরাবৃত্তি ও যন্ত্রণার জীবন মানুষের উপর চাপানো হয়েছে/ চেপে আছে তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ হতে পারে অনাগতদের এই অর্থহীন পুনরাবৃত্তি ও যন্ত্রণার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে জন্ম না দেয়া।

প্যারাডাইস লস্ট ও জন্মদানবিরোধ 

.

'প্যারাডাইস লস্ট' গ্রন্থের শেষের দিকে (পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী)  আদম ও হাওয়া যখন নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়ার অপরাধে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত, স্বর্গসুখের পরিবর্তে সামনে যখন যন্ত্রণা ও দুঃখের জীবন অপেক্ষা করছে, হাতের নাগালে খাবার পাওয়া বঞ্চিত হয়ে যখন ভবিষ্যতে শুধু বেঁচে থাকার খাদ্য সংগ্রহের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, অমরত্বের পরিবর্তে যখন মৃত্যুই অবধারিত হয়েছিল তখন হাওয়া/ইভ আদমকে কিছুটা এমন বলেছিলেন,

'চলো আমরা মরে যাই, আর কাউকে জন্ম না দিই যাদের অসহনীয় যন্ত্রণা সয়ে দুঃখে জীবন কাটাতে হবে, সামান্য বেঁচে থাকার খাদ্যের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, এত যন্ত্রণার পরেও অবধারিত রয়েছে তাদের জন্য হতাশাজনক মৃত্যু!  অপরাধ করে থাকলে আমি বা আমরা করেছি, যারা এখনো জন্ম নেয়নি তারা তো কোনো অপরাধ করেনি, আমাদের অপরাধের সাজা কেন নিরপরাধ আগামী প্রজন্ম ভুগবে? আমরা সন্তান জন্ম দিলে যন্ত্রণা ও হতাশার যে মৃত্যুর ধারাবাহিকতা চলবে তা আমাদের মৃত্যুর মাধ্যমেই শেষ হয়ে যাক!'

.

তখন অবশ্য আদম বলে আমরা স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছি কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ সন্তানেরা তো স্বর্গেও যেতে পারে, এক ত্রাণকর্তার (যীশু) জন্মের মাধ্যমে মুক্তিও পেতে পারে, ফলে সে আশায় ও ঈশ্বরের ক্ষমা লাভের আশায় আমাদের সন্তান জন্ম দেয়া উচিত! প্যারাডাইস লস্টের গল্প অনুযায়ী আদমের এই অবিবেচক ও নির্বোধ, স্বার্থপর আশাই মানবজাতির যন্ত্রণাদায়ক অস্তিত্বের কারণ। অথচ আদম বিবেচনা করতে পারতো, যে মানবজাতির অস্তিত্বই নেই তার মুক্তির জন্য তাকে দুঃখ-কষ্ট-সংগ্রামের পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল করা কি উচিত? আমরা অপরাধ করেছি, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি অপরাধ করবে না? যে ঈশ্বর আমাদের দুজনের ছোট অপরাধ ক্ষমা করেনি, সে ভবিষ্যতের মানুষদের আরও বড় অপরাধ ক্ষমা করবে? আমাদের অপরাধের জন্য অন্যরা যন্ত্রণা পাওয়া কি তাদের প্রতি অবিচার নয়? ভবিষ্যত মানুষদের একজনও যদি নরকযন্ত্রণা ভোগে তার দায় কি আমাদের নয়?

.

প্যারাডাইস লস্ট বইয়ের হাওয়া/ইভ যদি জন্মদানবিরোধী হয় আর আদম জন্মদানের পক্ষে, তাহলে সেটা আজও খুব সুন্দরভাবেই জন্মদানবিরোধী ও জন্মদানের পক্ষের লোকদের ভাবনার পার্থক্য তুলে ধরছে!


ফ্রাংকেস্টাইন, ঈশ্বর ও জন্মদানবিরোধ! 

.

মেরী শেলীর লেখা ফ্রাংকেস্টাইনে ভিক্টর ফ্রাংকেস্টাইন যেন ঈশ্বরের মতোই নিছক কৌতুহল বসে, নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে সংশ্লিষ্ট সৃষ্টির অনুভূতির কথা না ভেবেই বানিয়ে ফেলেছেন এক দৈত্য মানবকে। ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টির আগে যেমন তার মানুষ সৃষ্টির অভিজ্ঞতা ছিলো না (থাকা অসম্ভব) ঠিক তেমনি ফ্রাংকেস্টাইনেরও ধারণা ছিলো না দৈত্য মানব তৈরির পর কি হতে পারে। ফ্রাংকেস্টাইন অবশ্য তার ভয়ংকর ও কুৎসিত সৃষ্টি দেখে নিজেই তাকে পরিত্যাগ করেছে! আদম ও ফ্রাংকেস্টাইনের দৈত্য মানব উভয়ই ছিলো একা, ঈশ্বর আদমের জন্য লিলিথকে এবং পরবর্তীতে হাওয়াকে সৃষ্টি করেছিলেন সঙ্গিনী হিসেবে কিন্তু দৈত্য মানবের একাকীত্ব দূর করতে ফ্রাংকেস্টাইন কোনো সঙ্গিনী তৈরি করেনি। ফ্রাংকেস্টাইন ভেবেছে যদি দৈত্য মানব তার সঙ্গিনীকে পেয়ে আরো ভয়ংকর হয় কিংবা দৈত্য মানব মানুষের ক্ষতি না করলেও দৈত্য মানবী যদি লিলিথের মতো বিদ্রোহী হয় তখন কি হবে? যে শিক্ষা ঈশ্বর ভুল করে পেয়েছে সে শিক্ষাই ফ্রাংকেস্টাইন দেখে শিখেছে। ফ্রাংকেস্টাইন নিজের ও নিজের প্রিয়জনদের নির্মম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করলেও অবিবেচক ঈশ্বর নিজের ভুলের জন্য আদমের উপরই কেবল যন্ত্রণা চাপায়নি, সঙ্গিনীর মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়ে সে যন্ত্রণা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিয়েছে। ফ্রাংকেস্টাইন মানুষ হয়ে বুঝতে পেরেছে মানুষ একটা অতৃপ্ত ও অসুখী প্রাণী, দিগন্তের মতো আপাতদৃষ্টিতে সুখকে ছুঁয়ে ফেলা সম্ভব হবে বলে মনে হলেও মানুষ যত বেগে সুখের পেছনে ছোটে, সুখ মানুষের থেকে তত বেগে দূরে যাচ্ছে বলে মনে হয়। কিন্তু ঈশ্বর তো মানুষ নয়, সে মানুষের এই বাস্তব যন্ত্রণা কিভাবে উপলব্ধি করবে? কোটি কোটি মানুষ যন্ত্রণায় ভুগলেও তার কিছু যায় আসে না, মানুষ তার কাছে নিছক খেলার বস্তু ছাড়া কিছু নয়! ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেও তার কিছু আসে যায়নি, না করলেও তার কিছু এসে যেতো না।

.

এ তো গেলো ঈশ্বর-বিশ্বাসীদের কথা! আসলে তো ঈশ্বর বলে কেউ নেই বা থাকলেও জানার উপায় নেই, সেক্ষেত্রে মানুষের জন্মের, জীবনযন্ত্রণার একমাত্র কারণ মানুষই। ফ্রাংকেস্টাইনের মতো (নিজেরা বাবা-মা হওয়ার) অভিজ্ঞতা লাভের জন্য, সৃষ্টির (সন্তানের) মাধ্যমে অমরত্ব লাভের আকাঙ্খায় মানুষ যন্ত্রণার ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে! অথচ ফ্রাংকেস্টাইনের দুর্দশা থেকে কেউ শিক্ষা নিয়ে এ ধারাবাহিকতা বন্ধের কথা ভাবছে না! ফ্রাংকেস্টাইনের দৈত্য মানব যন্ত্রণা থেকে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার দায় যেমন ফ্রাংকেস্টাইনের তেমনিভাবে মানুষ জীবনের যন্ত্রণাবোধ থেকে যতরকম যন্ত্রণা পায় বা যন্ত্রণা দেয়, তার দায় তাকে অস্তিত্বে আনয়নকারী এড়াতে পারে না, সেটা ঈশ্বর হোক বা বাবা-মা।

.

যারা ফ্রাংকেস্টাইন পড়েও ঈশ্বর এবং বাবা-মায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে, তাদের উপলব্ধি সম্পর্কে আমার অনেক প্রশ্ন আছে!

সিলেনাস ও জন্মদানবিরোধ!

.

কিং মিডাসের গল্প জানে না এমন লোক খুব কমই আছে। কিং মিডাস 'গোল্ডেন টাচ' বা স্পর্শের মাধ্যমে সবকিছুকে স্বর্ণে পরিণত করার ক্ষমতা পেয়েছিল গ্রীক মিথোলজির ওয়াইন গড ডায়োনিসাসের মাধ্যমে। আর সেটা পেয়েছিলো জ্ঞানী সিলেনাসকে আশ্রয়, আপ্যায়ন ও ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। এই জ্ঞানী সিলেনাসের কাছে যখন কিং মিডাস জানতে চেয়েছিলো মানুষের জন্য সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত কি? প্রথমে এর জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানানো সিলেনাস বলেছিলেন, আমাকে কেন এমন বিষয় বলতে বাধ্য করছো যা না জানাই উত্তম, কেননা যে নিজের দূর্ভাগ্য সম্পর্কে জানেনা সে কম দুশ্চিন্তা করে বাঁচতে পারে। 

কিন্তু 

মানুষের জন্য সবচেয়ে উত্তম হলো কখনো জন্মই না নেয়া, অস্তিত্বেই না আসা, নারী পুরুষ কেউই প্রকৃতির জন্মদান পরম্পরায় অংশ না নেয়া, এমনটাই বাছাই করা উচিত ছিলো যদি মানুষকে বাছাই করার সুযোগ দেয়া হতো আর এরপরে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে জন্ম নেয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব মারা যাওয়া। 

.

এরিস্টটল অবশ্য তার লেখায় এ মিথোলজির উল্লেখের পাশাপাশি এটাও বলেছেন যে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষও ধরে নিতে পারে যে তার আগে মারা গিয়েছে সে অবশ্যই সবচেয়ে সুখী, কেননা বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া উত্তম!

.

আমরা যেহেতু জন্ম নিয়েছি, তাই জন্ম না নেয়ার সবচেয়ে উত্তম বিকল্প আমাদের ছিলো না কিন্তু প্রকৃতির জন্মদান পরম্পরায় অংশ না নেয়ার বিকল্প আমাদের হাতে আছে।

.

নীৎসে তার 'বার্থ অব ট্র্যাজেডি'তে জ্ঞানী সিলেনাসের এই ঘটনাটি এনেছেন এবং খুব সম্ভবত বলতে চেয়েছেন গ্রীকরা অতি সংবেদনশীল জাতি ছিলো বলে যন্ত্রণাভোগের দ্রুত সমাধান খুঁজতো, আর তখন যুদ্ধ, রোগ-বালাই, অনিরাপত্তার জন্য গ্রীকরা সবসময় অনিশ্চয়তায় ভুগতো! (কিন্তু অনিশ্চয়তা ও যন্ত্রণা কোন জাতি, কোন যুগে এড়াতে পেরেছে?) নিৎসে ডায়োনিসাসের আলোচনায় বলেছেন এই বিশৃঙ্খলার মাঝেই নিজেকে ভুলে অস্তিত্বের যন্ত্রণা অতিক্রম করতে হবে। যদি সেভাবে অস্তিত্বের যন্ত্রণা অতিক্রম আদৌ সম্ভব হয়ও, তবুও সেটা অস্তিত্বহীনতা, জন্ম না নেয়া, জন্ম না দেয়া কিংবা দ্রুত মরে যাওয়ার চেয়ে উত্তম কি?

চাপানো জীবন, চয়েজ/বাছাই  ও জন্মদানবিরোধ! 

.

কারো উপর কিছু চাপিয়ে দেয়া অন্যায় এটা সম্ভবত সবাই মেনে নেয়! আপনার যেটা পছন্দ এবং অন্য কারো ক্ষতি করছে না তা করতে না দেয়া কিংবা আপনি করতে না চাইলে আপনাকে কিছু করতে বাধ্য করাকে নিশ্চয়ই আপনি ন্যায় বলে মনে করবেন না? এজন্যই হয়তো ইচ্ছা বা অনিচ্ছার মূল্য না দিয়ে পর্দা করা ও বিভিন্ন বিধান পালন বাধ্যতামূলক করা ইসলামের অনুসারীরাও কেউ পর্দা করতে চাইলে তাকে করতে না দেয়াকে অন্যায় মনে করে। ধর্মে বিভিন্ন বিষয় বাধ্যতামূলক কেন জানতে চাইলে বলা হয় আপনি মুসলিম হলে ধর্মের আইন বিনা প্রশ্নে মানতে হবে আবার যদি ধর্ম ত্যাগ করার স্বাধীনতার কথা বলা হয় তখন দেখা যায় সে স্বাধীনতাও নেই। অর্থাৎ মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলে ধর্ম নামক খাঁচায় আপনি বন্দি এবং সেখান থেকে মুরতাদ হিসেবে হত্যাকান্ডের শিকার হওয়ার ঝুঁকি ছাড়া বের হবার কোনো সুযোগ ধর্মে নেই! এখন প্রশ্ন হলো মুসলিম পরিবারে আপনি কি স্বেচ্ছায় জন্ম নিয়েছেন নাকি আপনার ওপর মুসলিম পরিচয় চাপানো হয়েছে? 

.

আমাদের দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী মনে করেন অষ্টম শ্রেণি পাস করা একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান -ব্যবসায় - মানবিক কোন বিভাগ নেওয়া উচিত সেটা বাছাই করার মতো মানসিকভাবে উপযুক্ত হয় না। কথাটায় আসলেই যুক্তি আছে। কিন্তু আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা সবসময় মূল প্রশ্ন থেকে কোটি আলোকবর্ষ দূরে থাকেন এবং একটা গোষ্ঠীকে খুশি করতে চেষ্টা করেন বা খুশি করতে না পারলেও তাদের বিপক্ষে যায় এমন কিছু বলতে চান না! তাদের প্রশ্ন হতে পারতো একটা শিক্ষার্থী কোন ধর্ম শিখবে বা শিখবে না সেটাও তার মানসিক উপযুক্ততা অর্জিত হওয়ার পর বাছাই করার সুযোগ থাকা উচিত! 

একটা শিশু জন্ম নেওয়ার পর একটা বয়সে তার পরিবারের সামাজিক অবস্থা, আর্থিক সংগতি ও অন্য পারিপার্শ্বিকতার জন্য কেউ বাংলা ভার্সন, কেউ ইংরেজি ভার্সন, কেউ ইংলিশ মিডিয়াম, কেউ আলিয়া মাদ্রাসা, কেউ কওমি মাদ্রাসায় পড়তে হয়, তখন কি তাদের কোথায় পড়া উচিত সেটা বোঝার মানসিক উপযুক্ততা থাকে কিংবা বাছাই করার সুযোগ দেয়া হয়? যেসকল শিশু অভাবের জন্য পড়তে পারে না তাদের সবার জন্য কি সবগুলো অপশন থেকে যেকোনোটা বাছাইয়ের সুযোগ থাকে? জন্মের পর কোনো শিশুকে কি তার ধর্ম নিজে বাছাইয়ের সুযোগ দেয়া হয়? জন্মের পর থেকে একটা শিশুকে ধর্ম সহ বিভিন্ন বিষয়ে বাছাইয়ের কোনো সুযোগই না দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা রেখে নবম শ্রেণির বিভাগ পছন্দে লাফ দিয়ে চলে যায় কেন ইনারা?

.

এবার আসি মূল আলোচনায়! জন্মগ্রহণের আগে একটা শিশুকে অপশন দেয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। কোনো সিদ্ধান্তে (জন্মদানের) যার সম্মতি নেয়ার সুযোগ থাকে না অথচ সে ঐ সিদ্ধান্তের জন্য ফল ভোগ করবে এমনক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ঐ সিদ্ধান্ত না নিলে যদি তার কিছু না আসে যায় কিন্তু নিলে ভালো-খারাপ দুইটাই  হতে পারে তখন সে সিদ্ধান্ত না নেয়া!  এখন একজন চোর, সমাজে ঘৃণিত, দরিদ্র, দূর্ণীতিবাজ, অসৎ, ভন্ড, নিষ্ঠুর, বদমেজাজী, জেনেটিকালি রোগাক্রান্ত, অতি খুঁতখুঁতে, গোঁড়া ধার্মিক (এর বাইরে খুব কম লোকই থাকে) লোকের সন্তান হিসেবে একটি শিশুকে জন্ম নেয়া বা না নেয়ার অপশন দেয়া হলে সে কোনটা বেছে নিতো? একজন শিশুকে জন্মের আগে ধর্ম,সমাজ,জীবনসংগ্রাম, অনিশ্চয়তা সহ যা কিছু তার উপর চাপানো হবে সব জানিয়ে তার মতামত নেয়া হলে সে কি জন্ম দেয়ার পক্ষে মত দিতো? যেহেতু এটা জানা অসম্ভব তাই সর্বোত্তম হচ্ছে তাকে জন্ম না দেয়া। 

.

জন্মদানে শিশুর মতামত গ্রহণ না করা গেলেও জন্মদাতা-জন্মধাত্রীর মতামত তো গ্রহণ করাই যায়! তাহলে কি জন্মদান করা বা না করা মানুষের জন্য একটি চয়েজ নয়?

চয়েজ বটে তবে কাউকে খুন করা বা না করার মতোই চয়েজ! নৈতিকতা বিচার করলে কাউকে জন্ম দেয়া কোনো চয়েজ হতে পারে না। 

একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ দিই, ধরুন, একজন কোমায় থাকা রোগীর সাথে আপনি সেক্স (যদিও একপক্ষীয় এমন আচরণকে সেক্স বলা যায় কিনা প্রশ্নসাপেক্ষ) করলেন, যেহেতু ঐ রোগীর মতামত দেয়ার সুযোগ নেই তাই আপনি নিজের ইচ্ছাকেই গুরুত্ব দিলেন, রোগী আপনাকে বাধা দেয়নি বা আপনাকে জোরজবরদস্তি করতে হয়নি বলে এক্ষেত্রে কি বলা যায় কোমায় থাকা রোগীর সাথে সেক্স করা না করা আপনার একটা চয়েজ হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত?

আপনি সন্তান জন্মদান করে আরো ভয়াবহ কাজ করেন, তার উপর কেবল জীবন নয় ধর্মীয়, সামাজিক, পারিবারিক সহ জীবনসংগ্রাম ও অনিশ্চয়তার বোঝা চাপিয়ে দেন (সে প্রতিবাদ করতে অক্ষম বলে), এরপরেও কি বলা যায় সন্তান জন্ম দেয়া বা না দেয়া কারো চয়েজ হতে পারে? 

.

অন্য কারো জীবনের সিদ্ধান্ত আপনি বা আপনার জীবনের সিদ্ধান্ত অন্য কেউ নেয়া বা না নেয়া কখনোই চয়েজ হতে পারে না এটা মেনে নিলে, কাউকে জন্ম দেয়া বা না দেয়া আপনার চয়েজ হতে পারে কি?

গণতন্ত্র, কনসেন্ট ও জন্মদানবিরোধ!

.

আমি যে কেবল মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করি তা ই নয়, আমি পৃথিবীর বিচারব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পছন্দ করি। বিচারব্যবস্থায় কেবল অপরাধীকে শাস্তি দেয়া যায় না (তার পরিবার ও নিকটজনেরা বিনা অপরাধে শাস্তি পায়), যে ব্যবস্থা অপরাধ ঠেকাতে পারে না সে ব্যবস্থা অপরাধের শাস্তি দেয়ার অধিকার রাখে না,  শাস্তি কখনোই অপরাধের ক্ষতিপূরণ নয় বরং আরেকটি অপরাধ, শুধু এসব নয়, আরও একটি মৌলিক প্রশ্ন তোলা উচিত বলে আমার মনে হয়! প্রশ্নটা হচ্ছে - একজন মানুষকে জন্ম দিয়ে তার উপর সমাজের আইন-কানুন, নিয়ম চাপিয়ে দেয়া কি অন্যায় নয়? অনেকে বলে সমাজে বাস করতে হলে সমাজের আইন তো মেনে চলতেই হবে কিন্তু কথাটা এমন শোনায় যেন কেউ সমাজের সব আইন-কানুন জেনে জন্ম নেয়ার আগে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পায় যে এই সমাজে সে এসব আইন মেনে জন্ম নিতে চাইবে কিনা! কারো কনসেন্ট ছাড়া তার উপর জবরদস্তিমূলক কিছু চাপানো যদি অন্যায় হয়, তবে জন্মদানের মাধ্যমে জীবন,যন্ত্রণা,আইন, অনিশ্চয়তা,মৃত্যু এসব চাপিয়ে দেয়া কেন অন্যায় নয়?

.

গণতন্ত্র পৃথিবীর নিকৃষ্টতম পদ্ধতিগুলোর একটি যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠরা অপরাধ সমর্থন করলে সে অপরাধই আইন হতে বাধ্য! অধিকাংশ মানুষ জন্মদানকে অন্যায় মনে করে না বলে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বলা হয় অধিকাংশ মানুষের মতামতকেই গুরুত্ব দেয়া উচিত! কিন্তু যখন গণপিটুনি বা গণধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে একজন চায় তার সাথে এমন না ঘটুক এবং ঐ ঘটনার সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ অপরাধীরা চায় এমনটা ঘটুক, তখন কেন আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে গুরুত্ব দিই না? এর কারণ কারো সাথে জোরজবরদস্তি করা অন্যায়, সেটাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে ন্যায় বলা যায় না। যা একজনের অধিকার হরণ করে তা পৃথিবীর সব মানুষ সমর্থন করলেও সেটা অন্যায় বলেই বিবেচিত হওয়া উচিত। জন্মদান একজন মানুষের উপর তার কনসেন্ট ছাড়া জীবন চাপানো, তা পৃথিবীর সব মানুষ ন্যায় মনে করলেও, কোনো আইনেই অপরাধ না হলেও সেটা অন্যায়!

.

যারা জন্মদানের পক্ষে যুক্তি দেখান তাদের সবচেয়ে পছন্দের যুক্তি হচ্ছে, জন্ম নিলে তো সন্তান দুঃখের পাশাপাশি সুখও পেতে পারে!

কনসেন্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝাতে একটা উদাহরণ দিই, একটা ধর্ষণের ঘটনায় যদি ধর্ষিত হওয়া মানুষটিও সুখ অনুভব করে তবে কি সেটা অন্যায় হবে না? সুখ পাওয়া কি দুঃখ কিংবা জোরজবরদস্তিকে জাস্টিফাই করতে পারে?

আবার অনেকে যুক্তি দেখায় জীবন নিয়ে যারা হতাশ, যারা গরীব, যারা অসুস্থ কেবল তারা জন্মদান থেকে বিরত থাকবে, আমি ধনী,সুস্থ, জীবন নিয়ে খুশি, আমার সন্তান হতে পেরে সন্তান নিজেকে ধন্য মনে করবে, তাহলে আমি কেন সন্তান নিবো না? তাদের কথাটা কিছুটা এমন শোনায়- আমি সুপারস্টার, আমার বডি ফিটনেস ভালো, অনেক টাকা, আমার সাথে যেকোনো মেয়ে সেক্স করলে নিজেকে ধন্য মনে করবে, তাই কনসেন্টের কি প্রয়োজন? আপনি চরম নার্সিসিস্ট হতে পারেন কিন্তু যখনই অন্য একজনের জীবন ও স্বার্থ কোথাও জড়িয়ে আছে, সেখানে তার কনসেন্ট অবশ্যই প্রয়োজন!  তার কনসেন্ট ছাড়াই তার অসহায়ত্ব ও আপনার ক্ষমতা ব্যবহার করে আপনি কাজটি করতে পারবেন বটে, তবে সেটা অনৈতিক, অনৈতিক এবং অতি অবশ্যই অনৈতিক।

কান্টের দর্শন ও জন্মদানবিরোধ!

.

কান্টের একটা কথা আছে, মানুষকে মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা অনৈতিক। কান্টের এই কথাটার সীমাবদ্ধতা হলো উনি কেবল মানুষকে মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করাকে অনৈতিক বলেছেন, অন্য প্রাণীদের, বিশেষ করে অনুভূতিশীল প্রাণীদের কথা বিবেচনা করেননি। এখন কথা হলো, কাউকে মাধ্যম হিসেবে চেতন/অবচেতন মনে ব্যবহার করা ছাড়া কোনো মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব কি? আমার সহযোগী এডমিন একটা কথা বলে, মানুষ যদি কখনো বিলুপ্ত হয় সেটা হবে পরিপূর্ণ নৈতিকভাবে বাঁচার চিন্তা করতে গেলে কেননা পরিপূর্ণ নৈতিকভাবে বাঁচা সম্ভব নয়। এই নৈতিকতার চিন্তাই জন্মদানবিরোধের একটি শক্ত ভিত্তি। যন্ত্রণার অনুভূতি আছে এমন প্রাণী খাওয়া বাদ দিলেও উদ্ভিদকে বা প্রাণীজাত খাবারের জন্য প্রাণীকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। মানুষ চাইলে প্রবৃত্তির অনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারে আর সেটা করলে বিলুপ্ত হওয়া অবশ্যম্ভাবী! (যদিও আমরা মানুষরা যে পরিমাণ লোভী,স্বার্থপর,অস্থির,ক্ষণস্থায়ী আবেগী ও সংকীর্ণ চিন্তার লোক, তাতে নৈতিকতাকে সবাই গুরুত্ব দিবে এটা প্রায় অসম্ভব!)

.

কান্টের এ কথাটার সাথে জন্মদানবিরোধের সম্পর্ক কোথায়? কান্টের মতানুযায়ী মানুষকে মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা অনৈতিক। সন্তান জন্ম দেয়ার মাধ্যম হিসেবে কাউকে (পুরুষ/স্ত্রী) ব্যবহার করলে সেটাও কি অনৈতিক নয়? যদিও বিবাহ প্রথাটাও কান্টের মতানুযায়ী অনৈতিক কেননা নিজের একাকীত্ব দূর করতে বা যৌন চাহিদা পূরণের জন্য বিয়ে করলে মানুষকে একাকীত্ব দূর করা বা যৌন চাহিদা পূরণের জন্যই ব্যবহার করা হচ্ছে! (এ হিসেবে প্রেমও অনৈতিক বটে, কেননা প্রেমেও অপরপক্ষকে নূন্যতম হলেও ভালোলাগার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়!) এখানে অবশ্য যদি উভয়ে উভয়কে ব্যবহার করে তাহলে কাজটা নৈতিক না হলেও অন্তত কিছুটা কম অনৈতিক! কিন্তু সন্তান জন্মদানের কাজটি সম্পূর্ণ এবং চরম অনৈতিক। 

.

কিছুদিন আগে একটি নতুন সন্তান জন্ম দিয়ে পূর্ববর্তী সন্তানকে থ্যালাসেমিয়া মুক্ত করার ঘটনা ঘটেছে! এমন ঘৃণ্য,অনৈতিক কাজে দেখলাম অনেকে বাহবা দিয়েছে! একজন মানুষকে কেবলমাত্র অন্য একজনের রোগ ভালো করার মাধ্যম হিসেবে জন্ম দেয়া যাদের বিবেচনায় নৈতিক, জন্মদানবিরোধ তাদের জন্য নয়!

.

একটি শিশুকে জন্ম দেয়ার একটি প্রধান উদ্দেশ্য (অবচেতন) নিজের জিন পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়া, এক্ষেত্রে শিশুটি কেবল জিন ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা নিজের অজান্তেই নিজের জিন রক্ষার তাগিদ ছাড়া কিছুই নয়। এছাড়া সন্তান জন্ম দেয়ার সচেতন উদ্দেশ্যও বংশ রক্ষা, দাম্পত্য সম্পর্ক রক্ষা, বাবা/মা হওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ, বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন, একাকীত্ব দূর করা, সন্তানের সফলতায় নিজের অপূর্ণ ইচ্ছে পূরণ সহ যা ই হোক না কেন সবক্ষেত্রেই সন্তান একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু সন্তান জন্মদানের চরম অনৈতিকতা হচ্ছে সন্তান যেহেতু জন্মদানের আগে অস্তিত্বশীলই থাকে না তাই জন্মদানে সন্তানের কোনো স্বার্থ থাকে না, তাই সন্তান সম্পূর্ণভাবে আপনার স্বার্থসিদ্ধির একটি মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।

মন্তব্যসমূহ

নামহীন বলেছেন…
অসংখ্য ধন্যবাদ
নামহীন বলেছেন…
দিদি, অ্যান্টিন্যাটালিজম এর উপর লেখা কোনো বাংলা বই বাজারে পাওয়া যায় ? আমি খুলনা থেকে বলছি ।
মোহনা সেতু বলেছেন…
https://jonmodanberodhi.blogspot.com/?m=1
এই বইটি পড়তে পারেন।
ফ্রি পিডিএফ।
মোহনা সেতু বলেছেন…
https://drive.google.com/file/d/14T5Qzu1nTW8aWVQFFNtUW6qpUgdG1hxf/view?usp=drivesdk

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কাফকার মেটামরফোসিস

ঈশ্বরের সাথে বিদ্রোহ