জন্ম(যন্ত্রণা)দাতা

 আজ পরীক্ষার হলে ম্যাম আমার পাশে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ আমার খাতায় তাকিয়ে বললেন, 'তোমার হাতের লেখা তো অনেক সুন্দর। মাশাল্লাহ! '

একথা শোনার পর থেকে পুরোটা সময় মন খারাপ করে পরীক্ষা দিয়েছি।

ম্যামকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো- 'ম্যাম, আপনি তো আমার হাতের লেখাটা দেখলেন, এর পেছনের সত্য গল্পটা জানলেন না!'

"

আমার শিশুকালের কথা। আমার বাবা আমাকে হাতের লেখা শেখাতেন লাঠি নিয়ে বসে। আমি ছোট্ট মানুষ!  ভয়ে কেঁপে কেঁপে লিখতাম। লেখা শেষে তিনি স্কেল দিয়ে মেপে মেপে দেখতেন সোজা হয়েছে কি-না। 

একটু এদিক-সেদিক হলেই মারতেন, বকতেন, অপমান করতেন, খাবার বন্ধ করতেন!

তিনি আমাকে বড় করতে চেয়েছেন একজন সেনাসদস্যের মতো করে! 

ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠা, শরীরচর্চা করা, পড়া, গোসল এবং খাওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া। 

তিনি আমার মধ্যে নিজের কার্বনকপি রেখে যেতে চেয়েছেন।  

এজন্য আমার শৈশবটা নষ্ট করেছেন যেন হুবহু তার লেখার মতো আমার হাতের লেখা হয়। 

হয়েছেও তাই। আমরা দু'জনবাদে কেউই আলাদা করে ধরতে পারে না।

তিনি ভালো বাবা হওয়ার জন্য অধ্যবসায় করতেন। ভাবতেন আমার সাথে যা করছেন সবই আমার ভালোর জন্য।

হোক কঠিন শাস্তি তবুও তা আমার সুন্দর স্বর্ণোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ  এনে দিবে।

এজন্য তীব্র শীতের রাতে ১২ টার আগে ঘুমানোর অপরাধে এবং ভোরবেলায় ঘুম থেকে না জাগার অপরাধে বিছানায় পুরো এক বালতি পানি ঢেলে দিতেন। 

"

তবে ভালো স্মৃতিও আছে। 

আমরা যখন বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে থাকতাম তখন আমাকে হাত ধরে শিশুপার্কে নিয়ে যেতেন, মাঝেমাঝে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতেন। 

তবে তিনি সবচেয়ে মনোযোগ দিয়ে যা করতেন তা হলো- আমাকে সামান্য ভুলেই লাঠিপেটা করা, বকাঝকা করা, আত্মীয় এবং মানুষের সামনে অপমান করা।

যা আমার সকল ভালো স্মৃতিকে ধুয়েমুছে দেয়।

মনে করতেন, আমাকে যেহেতু তিনি পৃথিবীতে এনেছেন সেহেতু আমাকে যখনতখন মারধোর করতে পারবেন, অপমান করে কথা বলতে পারবেন।

কারণ হিসেবে বলতেন, আমার ভালোর জন্যই করছেন।

ভালো তো হয়েছেও!

আমি বড় হয়েছি ভীতু, রোগা, লিকলিকে আর পিঠের তীব্র যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে ; যার এই যন্ত্রণাবাদে কোনো বন্ধু নেই!

"

তিনি উর্দু কবিদের মতো দুঃখকে এতো তীব্রভাবে অনুভব করতেন যা আমাকে মুগ্ধ করে দেয়। 

কিন্তু তিনি কী করলেন?

আমাকেও দুঃখকে তীব্রভাবে অনুভব করার জন্য দুঃখ দিতে থাকলেন।

তার কাছে জীবন এবং মৃত্যু রহস্যময় এক ধাঁধাঁ যার ভেদ তিনি একজীবনে উদঘাটন করতে পারেননি তাই তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্তের জন্য আমাকে আনলেন। 

আমিও তার মতোই দিশেহারা অবস্থায় আছি। 

আসলে এসবের ভেদ উদঘাটন করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়!

"

আমরা সবসময় সুন্দর ভবিষ্যতের কথা বলি।

আমাদের সন্তানদের নিয়ে খুব আশাবাদী থাকি।

সন্তান নিজের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হবে এমন স্বপ্ন দেখি আর পূরণ করতে মরিয়া হয়ে ভুলে যাই সন্তান আলাদা একটা সত্তা!

"

আমি আমার শৈশবকে জলাঞ্জলী দিয়ে যে হাতের লেখা কিনেছি তার বিনিময়ে এই প্রশংসা কি আমার জন্য যথেষ্ট?!

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কাফকার মেটামরফোসিস

ঈশ্বরের সাথে বিদ্রোহ

জন্মদানবিরোধ সব পর্ব একত্রে (শামস অর্ক)